শাহবাগ থেকে টিএসসি বরাবর সোজা হাঁটতে থাকলে চারুকলার ৩ নং গেটের সামনে দেখা যায় বইয়ের একটি ভ্যান। সেখানে লেখা, 'মঙ্গল আলোর ধারক বইপোকা।'
২০১৩ সাল থেকে এভাবে ভ্যানে করে বই বিক্রি করছেন মধু মন্ডল। চাপদাঁড়ির শ্যামবর্ণ বাবড়ি চুলের এই মানুষটিকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় চারুকলার সামনেই। এছাড়া বিকেলের পর থেকে আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের পাশেও (গ্রন্থাগার গেটের ভেতরে) তার দেখা মেলে।
তার কাছে সাধারণত কোনো একটি বইয়ের একটি করেই কপি থাকে। তবে কিছুক্ষেত্রে পাঠক চাহিদা বেশি হলে একটি বইয়ের তিন - চারটি করে কপি বিক্রি হয়। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন - সবরকম বই মেলে তার কাছে।
তিনি এই উদ্যোগ শুরুর বিষয়ে বলেন, '২০০৮ সালের কথা। আমি তখন ধানমণ্ডি ল কলেজের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই - আলমগীর হোসেন রিপনের সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি আর আমি তখন ফুটপাতে মাদুর বিছিয়ে বই বিক্রি করতাম। এরপর ২০১৩ সাল থেকে বই বিক্রি শুরু আমাদের ঠিক করা বইপোকা নামের এই ভ্যানে।'
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর সম্পন্ন করেননি তিনি। বইকে ভালোবেসে ঠিক করেন সার্বক্ষণিক বইয়ের সাথেই থাকবেন। মুক্তভাবে জ্ঞান অর্জন করবেন। মানুষকেও জ্ঞানার্জনে সহায়তা করবেন।
এ বিষয়ে বললেন, “আমি ২০১৩ সাল থেকে এখানে ভ্যানে বই বিক্রি করি। তখন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চারুকলার সামনে থাকতাম৷ তারপর বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের পাশে। তারপর আবার বিজয় একাত্তর হলের ওখানে যেতাম।”
“হলের নির্মাণ কাজ তখন চলছে। এরপর রাত নয়টার দিকে আবার যেতাম পলাশীতে। সেখানে এগারোটা - বারোটা পর্যন্ত থাকতাম। ভ্যানে থাকা বই থেকে নিজেও বই পড়তাম৷ একসময় মনে হলো, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরেও অন্য অনেক বিষয় আছে যেসব আমি জানিনা। বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলো। তখন ভাবলাম সবসময় বইয়ের সাথে থাকবো। এতে মানুষকেও পড়ার পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারবো। সেই ভাবনা থেকেই বই বিক্রিকে জীবন ও জীবিকার মাধ্যম বানালাম।”
তবে এর ভেতরই ঘটে যায় খুব দুঃখজনক এক ঘটনা। ২০১৪ সালের একরাতে সব বইসহ তার ভ্যানটি চুরি হয়ে যায়।
এ নিয়ে তিনি বললেন, “সে সময় ভ্যানে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকার বই ছিলো। জিডি করেছিলাম। তবে ভ্যানটা আর পাওয়া গেলো না। অবশ্য পাওয়া যাবে তা আমি ঠিক আশাও করিনি। তবে সেই পরিমাণ বই আজও আর আনা যায়নি।”
এরপর আবার নতুন করে ভ্যান কিনে বই বিক্রি শুরু করেন মধু। বললেন, “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে বিজ্ঞানের প্রতি ভালো লাগা জন্মায়। এছাড়া মার্কসীয় দর্শন সম্পর্কিত বইগুলো আমার চিন্তার বিকাশে সহায়তা করেছে।”
প্রিয় বই ও লেখকের বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মরিস কর্নফোর্থ ও অমল দাশগুপ্তের কথা।
দেবীপ্রসাদের বেশকিছু বই পড়েছেন তিনি। তার ভ্যানে দেবীপ্রসাদের বইয়ের সংখ্যাই বেশি। তার লেখা থেকে মধু জেনেছেন বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজের অনেক গূঢ় বিষয় সম্পর্কে। অমল দাশগুপ্তের মহাকাশের ঠিকানা, পৃথিবীর ঠিকানা, মানুষের ঠিকানা ও প্রাণের ইতিবৃত্ত - এই বইগুলো তার ভীষণ প্রিয়। মানুষ ও সমাজকে বুঝতে চাওয়ার পেছনে বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মরিস কর্নফোর্থ এর নাম। মরিসের 'দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ' বিষয়ক বইগুলো (৩ খণ্ডে প্রকাশিত) তার চিন্তার জগত নির্মাণ ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে জানান তিনি।
এ সময়ে মানুষের পাঠ্যাভাস কমছে বলে কথা প্রচলিত আছে। মধু পুরোপুরি একমত হননি। তার মতে, “মানুষের হাতে এখন অনেক কিছু আছে। তবে যাদের বই পড়ার ইচ্ছা আছে, তারা এখনো বই কেনে। দিনে পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বই বিক্রি হয়। অনেকের আগ্রহ আছে পড়ার প্রতি।”
সাধারণত বাংলাবাজারে মূল প্রকাশনী থেকে, আর নয়তো নীলক্ষেতের ডিলারদের কাছ থেকে বই কেনেন তিনি। বিক্রির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশের মতো ছাড় দিয়ে থাকেন। এই বই বিক্রিকেই জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি বইয়ের সাথে আছি, সারাজীবন তাই থাকতে চাই। বই বিক্রি করেই চলছি। ভালোভাবে থাকা বা চলাফেরা বলতে শুধু অর্থবিত্ত বোঝায় না। ভালোভাবে থাকার জন্য বেশি প্রয়োজন মানুষের চিন্তার বিকাশ। কারণ, চিন্তাটাই মানুষকে গড়ে তোলে, মানুষকে পরিবর্তন করে। আমি মনে করি, মানুষের চিন্তা ও মননের বিকাশের জন্য সবচেয়ে সহায়ক হলো বই। আমি বই বিক্রির মাধ্যমে মানুষের মনন বিকাশে একরকম সহায়তা করছি। এখানে যেসব বই আছে সেসব সাধারণত এই উদ্দেশ্যেই রাখা।”
তবে তিনি মনে করেন ভ্যান চুরির ঘটনাটি না ঘটলে তার সংগ্রহ আরো ভালো থাকতো। বেশকিছু বই পরে আর আনতে পারেননি তিনি। আবার পুঁজির স্বল্পতাও এক্ষেত্রে একটি বিষয়।
মধু মণ্ডল মনে করেন নিজে বইয়ের সাথে সর্বক্ষণ থাকা ও পড়া তার শিক্ষা গ্রহণকে চলমান রেখেছে। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরেও জানার - বোঝার যে বিপুল জগত, সেই জগতে তাকে নিয়ে এসেছে বই। তাই নিজে পড়ে ও অন্যদের জন্য বই বিক্রি করে তিনি তৃপ্ত।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। [email protected]