পুঠিয়া রাজবাড়ি - রানীর বাসবভবন থেকে কলেজ


আসমাউল-হুসনা পূষন | Published: February 03, 2023 16:16:57 | Updated: February 03, 2023 20:57:32


পুঠিয়া রাজবাড়ি - রানীর বাসবভবন থেকে কলেজ

পদ্মা পাড়ের শহর রাজশাহীতে অবস্থিত পুঠীয়া রাজবাড়ী বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রাজশাহী বিভাগীয় শহর থেকে ৩০ কিলমিটার এবং রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক থেকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থাপত্য।

সপ্তদশ শতকে মোগল আমলে বাংলার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পুঠিয়া জমিদারি নামে পরিচিত ছিল। তবে কথিত আছে, জনৈক নীলাম্বর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫—২৭ খ্রি.) কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করার পর সেটি পুঠিয়া রাজবাড়ীরূপে পরিচিতি লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইন্দো-ইয়োরোপীয় স্থাপত্যে নির্মিত এই রাজবাড়ি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে থাকা লস্করপুর ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

পুঠিয়া রাজবাড়ী (পাচঁআনি জমিদারবাড়ি) ছিল মহারাণী হেমন্তকুমারী দেবীর বাসভবন। ১৮৯৫ সালে শাশুড়ী মহারানী শরৎ সুন্দরীদেবীর সম্মানে হেমন্তকুমারী দেবী নির্মাণ করেন এই আয়তাকার দ্বিতল প্রাসাদটি। ভবনের সম্মুখ ভাগের স্তম্ভ,অলংকরন, কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়ালে ও দরজার উপর ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম চমৎকার নির্মাণ শৈলীর পরিচয় বহন করে। রাজবাড়ীতে ব্যবহার করা হয়েছে সমতল ছাদ এবং ছাদে লোহার বীম, কাঠের বর্গা এবং টালি । বিভিন্ন সময় জমিদার/রাজাগণ প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে এখানে নির্মাণ করেন উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কাঠামো ও মন্দির।

পুঠিয়ায় অবস্থিত অধিকাংশ মন্দিরে পোড়ামাটির ফলক স্থাপিত আছে। পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে পাঁচআনি রাজবাড়ী বা পুঠিয়া রাজবাড়ী, চারআনি রাজবাড়ী ও ১৩টি মন্দির । রাজবাড়ীর আশে পাশে ছয়টি রাজদিঘী আছে। প্রত্যেকটা দিঘীর আয়তন ছয় একর। নিরাপত্তার জন্য রাজবাড়ির চারপাশে খনন করা হয়েছিল পরিখা।


জমিদার বাড়ি অঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দ মন্দির যা একটি উচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত বর্গাকার নির্মিত। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে একটি কক্ষ ও চার কর্ণারে রয়েছে ৪টি বর্গাকৃতির ছোট কক্ষ। গর্ভগৃহের চারপাশে রয়েছে ৪টি খিলান প্রবেশ পথ।


মন্দিরের পিলার ও দেয়াল অসংখ্য দেব-দেবী, যুদ্ধের সাজসজ্জা, ফুল ইত্যাদির পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সজ্জিত। জানা যায় প্রেম নারায়ণ রায় আঠারোশ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে এই মন্দির নির্মাণ করেন।


পুঠিয়া রাজবাড়ীর দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ছোট আহ্নিক মন্দির আয়তাকার নির্মিত উত্তর দক্ষিণে লম্বা এ মন্দিরেরপূর্বদিকে পাশাপাশি ৩টি এবং দক্ষিণ দেয়ালে ১টি খিলান দরজা আছে। মন্দিরের ছাদ দোচালা আকৃতির এবং আংশিক বাঁকানো।

বর্গাকারে নির্মিত ছোট আকৃতির ছোট শিব মন্দির রাজবাড়ী হতে ১০০ মিটার দক্ষিণে পুঠিয়া-আড়ানী সড়কের পূর্বপাশে অবস্থিত। মন্দিরের দক্ষিণ দেয়ালে ১টি মাত্র খিলান প্রবেশপথ, রয়েছে আংশিক বাকানো কার্নিশ যা পোড়ামাটির অলংকরণ দিয়ে সাজানো।


পাঁচআনি জমিদার ভুবেন্দ্রনারায়ণ রায় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন দোল মন্দির যা ৪ তলা বিশিষ্ট। মন্দিরের চতুর্থ তলার উপরে আছে গম্বুজাকৃতির ছাদ।


পুঠিয়া বাজারে প্রবেশ করতেই হাতের বাম পাশে অবস্থিত শিবসাগর নামক দীঘির দক্ষিণ পাড়ে বড় শিব মন্দির যা রানী ভূবনময়ী দেবী ১৮২৩ সালে নির্মাণ করেন। উচু মঞ্চের উপর নির্মিত মন্দিরটির দক্ষিণ দিকে সুপ্রশস্ত সিড়িসহ প্রধান প্রবেশপথ।


মন্দিরের চারপাশে টানা বারান্দা এবং বারান্দায় রয়েছে ৫টি করে খিলান প্রবেশপথ। মন্দিরের উত্তর পাশে অবস্থিত দীঘিতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট রয়েছে। বড় শিব মন্দির সংলগ্ন পূর্বদিকে অবস্থিত শিবসাগর নামক দীঘির দক্ষিণ পাশে জগন্নাথ বা রথ মন্দির। মন্দিরটি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রানী ভূবনময়ী কর্তৃক নির্মিত বলে জানা যায়।


পুঠিয়া-রাজশাহী মহাসড়কের তারাপুর বাজার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দক্ষিণে এবং পুঠিয়া বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি পুকুরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হাওয়াখানা। দ্বিতল এ ইমারতটির নীচতলা আর্চযুক্ত। জানা যায় পুঠিয়া রাজবাড়ীর সদস্যরা রাজবাড়ী থেকে রথ বা হাতিযোগে, পুকুরে নৌকায় চড়ে এসে অবকাশ যাপন এবং পুকুরের খোলা হাওয়া উপভোগ করতেন।


পশ্চিমে কৃষ্ণপুর গ্রামে খোলা মাঠে রয়েছে একটি গোবিন্দ মন্দির যা স্থানীয়ভাবে এটি সালামের মঠ নামে পরিচিত। এটির প্রবেশপথের উপরে ও দুইপাশে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকের নান্দনিক কারুকাজ। এছাড়াও দর্শনীয় স্থাপত্যের মাঝে আরও রয়েছে চারআনি জমিদারবাড়ী, বড় আহ্নিক মন্দির, গোপাল মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির - সহ মোট ১৪টি স্থাপনা যেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করেছে।


কালের বিবর্তনে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে, বিলুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা সাথে সাথে পুঠিয়া রাজবাড়ীর জমিদারিও। কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে আমলে নির্মিত জমিদারদের সেই প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা। সপ্তদশ শতকের বাংলার এই প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য যদি ঘুরে দেখতে চান তাহলে পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে পুঠিয়া রাজবাড়ীকে।


asmaulhusnapushon@gmail.com

Share if you like