Loading...
The Financial Express

পরার্থপরতার অর্থনীতি: হাস্যরসে শাস্ত্র

| Updated: September 14, 2022 16:35:06


পরার্থপরতার অর্থনীতি: হাস্যরসে শাস্ত্র

অর্থনীতি শব্দ শুনতে ভারি। বুঝতে গেলে আরো কয়েক কাঠি সরেস। অর্থশাস্ত্রের ভাবনা এ তল্লাটে নতুন না। তবে সে অর্থে অর্থনীতি নিয়ে বাংলা ভাষায় মৌলিক লেখা খুঁজতে যাওয়া অমাবস্যার চাঁদ। অবশ্য অমাবস্যায় চাঁদও হাতে পাওয়া যায় যদি সে ভাষায় একজন আকবর আলী খান থাকেন।

“পরার্থপরতার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে প্রবাদ পুরুষ হলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। তিনি সপ্তম শতকে কনৌজের সম্রাট ছিলেন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে হর্ষবর্ধন ছিলেন অতি দানশীল রাজা। প্রতি চার বছরে একবার তিনি প্রয়াগের মেলায় তাঁর সর্বস্ব দান করতেন। সব কিছু দেওয়া হয়ে গেলে তিনি তাঁর নিজের গায়ের কাপড় দান করে গঙ্গায় স্নান শেষে অন্যের বস্ত্র ধার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন। ইতিহাসের এ কিংবদন্তী নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। তবু কিংবদন্তীটি সম্পর্কে ছাত্রজীবনে আমার মনে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এ সব প্রশ্নের জবাব আমি কো্নো ঐতিহাসিকের কাছে পাইনি।”

এভাবেই ইতিহাসের বিভিন্ন খুটিনাটির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মিশেলে হাস্যরসে ড. আকবর আলী খান লিখেছেন পরার্থপরতার অর্থনীতি । যাকে তিনি নিজেই বলছেন আবার হতাশাবাদী এবং একই সাথে দুর্বোধ্য জ্ঞান। আবার তিনিই ১৫ প্রবন্ধের বইয়ে ছন্দ, গদ্য, হাস্যরসের শিরোনামে লিখলেন সহজবোধ্য, সুখপাঠ্য এক অর্থনীতি পাঠের বই।

অর্থশাস্ত্রকে কৌটিল্য যতই কুটিল করে থাকেন না কেন, যেকোনো পাঠকের শাস্ত্রজ্ঞানের আগ্রহ নিবারণ সম্ভব এই বই দিয়ে। বইটির প্রথমেই নাম ভূমিকার এক প্রবন্ধে লিখেছেন মূলত দান খয়রাতের অর্থনীতি। দান খয়রাত এ এলাকায় পুরনো প্রচলিত বিষয়। তবে এর রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। তত্ত্বে দীর্ঘদিন দান খয়রাতের অর্থনীতি যে উপেক্ষিত ছিল তাও এ অংশের গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তি। তবে মূল কথা দাঁড়ায় এই যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিঃস্বার্থ হলে পরেই তা মূলত ফলপ্রসু হতে পারে।  

দ্বিতীয় প্রবন্ধের নাম রীতিমত হকচকিয়ে ওঠার মত। ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজদের অর্থনীতিকে ভর্ৎসনা করেছেন লেখক এ প্রবন্ধে। এ পর্বেও যথারীতি সরস লেখনী। দুর্নীতির জীবন্ত বর্ণনায় টানলেন ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরামের কবিতা,

“সরকার হইলো কাল খিল ভূমি লিখে লাল

বিনা উপকারে খায় ধুতি।”

রাজস্ব কর্মকর্তারা যে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় তার জন্যই এ কবিতার অবতারণা। সময়ের নিরীখে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এ প্রবন্ধ।  

সংস্কারমুখী রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ পর্ব শেষে লেখক লিখেছেন এ বইয়ে তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় প্রবন্ধ মোল্লা নাসিরুদ্দিনের অর্থনীতি। মোল্লা নাসিরুদ্দিন যে একজন অত্যন্ত শ্লেষাত্মক চরিত্র তা আগেই জানা। তবে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় যখন তার অর্থনীতি নিয়ে কথা বলা হয়। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের হাস্যরসাত্মক চুটকিগুলোর মধ্যেও যে লুকিয়ে রয়েছে অর্থনীতির মৌলিক কিছু তত্ত্ব তা নিয়েই এ প্রবন্ধ।

মোল্লা একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ছাদ থেকে এক ব্যক্তি তার ওপর পড়েন। এতে ঐ ব্যক্তির তেমন কিছু না হলেও মোল্লাকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হসপিটালে যেতে হয়। এ বিষয়ে মোল্লা বলেন কার্যকরণের অবশ্যম্ভাবিতায় যেনো বিশ্বাস না করে কেউ। সুতরাং এই যে দার্শনিক অর্থনীতির ব্যাখ্যায় কার প্রভাব কোথায় পড়ে তা ঠাহর করা যে মুশকিল তা মোল্লা নাসিরুদ্দিন স্পষ্ট বুঝিয়ে গেলেন তার উপদেশে।

শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি নামের প্রবন্ধে পুঁজিবাদের সাথে সমাজবাদের অঙ্গাঅঙ্গি সম্পর্ক এবং কীভাবে একে অপরকে টিকিয়ে রাখে তার স্বার্থে তার প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন লেখক। পুঁজির পৃথিবী ছাড়া সমাজবাদের যেমন কোনো গুরুত্ব নেই তেমনি সমাজবাদকে নানা অনুসঙ্গ দিয়ে আবার পুঁজির অনুসঙ্গ বানিয়ে নেয় পুঁজিবাদ।  

এর সূত্র ধরে বাদ যায়নি বাংলার ছলনার অর্থনীতিও। সোনার বাংলা: অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত নামক প্রবন্ধে বাংলার অর্থনীতি নানা ছলাকলায় কীভাবে প্রচলিত সত্য ও মিথ্যার অন্তরালে আমাদের সামনে দেখানো হয় তার বিবিধ ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে,

“অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ হতে “সোনার বাংলা” একটি অলীক কল্পনা মাত্র, বাস্তবে এর অস্তিত্ব ছিল না। অবশ্য ঐতিহাসিকগণ অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক যুক্তি মানেন না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে তত্ত্বের ভিত্তিতে নয়, বরং ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তিতেই প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব।”

সরল করে বললে ঐতিহাসিক তত্ত্ব দিয়ে অর্থনীতির বিশ্লেষণ যে করা যায় না তা না, তবে আসল তথ্য কেবল মাত্র অর্থনৈতিক তত্ত্বেই করা যায় তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়েছেন আকবর আলী খান। মূলত এখানে এভাবেই নানা কলাকৌশল করে মানুষকে সঠিক চিত্র জানতে-বুঝতে দেওয়া হয় না।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব লেখকের ওপর রয়েছে। লেখার কিমিয়াতে স্পষ্ট আবার শিরোনাম ও শিরোধার্য করেছেন একটি প্রবন্ধের আজি হতে শত বর্ষ পরে: অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখানে মূলত এক সময় যে কাঠামোবদ্ধ অর্থনীতি চর্চার মাধ্যমে সুদিনে পৌঁছানো যেতে পারে তা নিয়ে লেখা হয়েছে। আবার এর জন্য যে ঠিক কী ধরনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত হবে তার ও পরামর্শ সূচি রয়েছে।

মানুষের অর্থনীতির ধারণা অর্থনীতিবিদেরা কীভাবে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন আধুনিক অর্থনীতিতে সে কথাও এখানে বলা হয়েছে। করা হয়েছে রসাত্মক আত্মসমালোচনা ও। প্রবন্ধের নামেও আছে বৈচিত্র্য ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ ও মানুষ হিসাবে অর্থনীতিবিদ।

শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শনের নিরীখে রয়েছে আরো বেশ কিছু সহজাত সরস প্রবন্ধ। শেষ পর্যায়ে লিখেছেন স্কট গর্ডন সুন্দরভাবে বলেছেন:

নিখুঁত পরিচ্ছন্নতাও অসম্ভব, কিন্তু এতে পরিষ্কার না করার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন হয় না, আর এ জন্য ময়লার স্তূপে গড়াগড়ি খাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না।

তার পুরো লেখার মূল্যায়ন স্কট গর্ডনের এ উক্তি দিয়ে ড. আকবর আলী খান নিজেই বুঝিয়ে গেছেন। বাকি কাজ পাঠকের। আড্ডাপ্রবণ বাংলার পাঠকেরা অর্থশাস্ত্রীয় তর্ক আড্ডার খোরাক পাবেন।

মোজাক্কির রিফাত বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic