Loading...
The Financial Express

ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে কতটা নৈতিক?

| Updated: September 22, 2022 17:50:30


ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে কতটা নৈতিক?

বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার এক নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ধর্ষকের। ঢাকার একটি আদালতের নির্দেশে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়।

মঙ্গলবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়। খবর বিবিসি বাংলার।

কী ঘটেছিল?

ধর্ষণের শিকার তরুণীটি ঢাকার বাড্ডা থানায় যে মামলা করেন সেই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ওই তরুণী ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আসামি তৌহিদুল ইসলামের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন।

কাজ শুরুর কিছুদিন পর থেকেই আসামি তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন।

ওই বছরের ১০শে জানুয়ারি থেকে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত আসামি ওই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন।

মেয়েটি অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি দুই মাসের গর্ভবতী। এই অবস্থায় তিনি মামলা করলে পুলিশ তৌহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে।

মামলা চলা অবস্থায় ভিকটিম সেন্টারে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন বাদী। সেই ছেলের বয়স এখন দুই বছর।

বাদী পক্ষের আইনজীবি এম. আবু বক্কর সিদ্দিক মোল্লা বলেন, "আদালত বলেছিল আপনারা বিয়ে করে আসছেন কিনা, সেই সময় তারা (আসামীপক্ষ) বলে তারা বিয়ে করেনি। তবে আদালত অনুমতি দিলে আজ মঙ্গলবার তারা বিয়ে করে আসতে পারেন। তখন বিচারক নির্দেশ দেস, তাহলে আজকে (মঙ্গলবার) বিয়ে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে না হচ্ছে ততক্ষণ আমি আদালতেই থাকবো।"

মি. মোল্লা বলেন, আসামী পক্ষ দুই লক্ষ টাকা দেনমোহর দিতে চেয়েছিল কিন্তু বাদী পক্ষের হয়ে তিনি ১০ লক্ষ টাকা দেনমোহর দাবি করেন। পরে আদালত সিদ্ধান্ত দিলে পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হয় সাত নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।

আদালত রায়ে তার পর্যবেক্ষণে বলেন, "এই মামলাটাকে খারিজ করা হচ্ছে না। মামলাটা আমার কাছেই থাকবে। আমি দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে মামলাটাকে পর্যবেক্ষণে রাখবো - আসলেই ভিকটিম সুখে আছে কিনা, আসামী তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে কিনা, তাকে সুখে রাখছে কিনা," জানান মি. মোল্লা।

এই বিষয় নিয়ে আসামী পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা মন্তব্য করতে চাননি। আসামিকে পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় আগামী ২৯শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জামিন দেয়া হয়েছে।

নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন

ধষর্ণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনা এটাই প্রথম না।

দু'হাজার বিশ সালে ফেনীতে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

পরে আসামী পক্ষ ঐ নারীকে বিয়ে করতে চায় এটা জানালে আদালত তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত দেয়। এবং ঐ ব্যক্তি এক বছরের জন্য জামিন পায়।

কিন্তু একজন ধর্ষকের সঙ্গে ঘটনার শিকার নারীর বিয়ের এই সিদ্ধান্তকে দু'পক্ষের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে করা হয়, এমন কথা বলা হলেও সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি শারমিন আক্তার বলেন, বাংলাদেশের আইনে কিছু অপরাধ আছে যেগুলোর কোন আপোষ-মীমাংসার সুযোগ নেই।

ধর্ষণের ঘটনা তেমনি একটা-যেখানে কোন আপোষের সুযোগ নেই।

তিনি বলেন "যেখানে বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পরে হত্যা করা এ ধরণের ঘটনায় আরবিট্রেশন বা আপোষ-মীমাংশার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমাদের সমাজে আপোশ মীমাংসার নামে যেটা হয় সেটা হল বিভিন্ন মহল থেকে নানা ভাবে চাপ তৈরি করা হয়।

"এছাড়া আমরা যদি আমাদের সোসাইটির ধরণের কথা চিন্তা করি তাহলে একটা ধর্ষণের শিকার নারী সোসাইটিতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পরে। তার পরিবারের জন্যও একই ঘটনা ঘটে। তখন দেখা যায় সমাধানের জন্য টাকা-পয়সা দিয়ে রাজি করানো হয়।"

তিনি বলেন, "একজন ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে করাটাতে ঐ নারীতো আরো একবার মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। পরে আবার দেখা যায় জামিন নিয়ে আসার পর আসামী কোন কারণ ছাড়াই ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ফলে ঐ নারী কিন্তু আবারো মুখ থুবড়ে পড়ছে। তার জীবনের কোন নিরাপত্তা সে পাচ্ছে না। তাই এই ধরণের বিয়ে নৈতিকতার দিক থেকে, আইনগত দিক কোন ভাবেই সমর্থিত না।"

সমাজে ভুল বার্তা যাবে কিনা

একজন নারী ধর্ষনের শিকার হলে অনেক সময় গ্রামীণ শালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।

সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরিন বলেন "এটা খুব দুঃখজনক। বিভিন্ন কমিউনিটির মধ্যে অপরাধ যে করে, তার সঙ্গে সমঝোতা করে দিচ্ছে, অনেকে মানতে চান না। একটা মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক অবস্থা যে, সে যে ব্যক্তির দ্বারা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে তাকেই মেনে নিতে হচ্ছে। এখানেই অনেক সময় মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা করে না পরিবারগুলো। তারা তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে যেটা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।"

"আর আমরা এর আগে অনেক ঘটনা দেখেছি যে আসামী জামিন পেয়ে যায়, ফলে যারা অপরাধীরা ভাবে ধর্ষণ করা সহজ ব্যাপার। প্রথমত, বাংলাদেশের সিস্টেমে এটা প্রমাণ করা কঠিন আর যদি কেউ প্রমাণও করে তাহলে বিয়ে করে জামিনে বের হয়ে আসা যায় যেটা খুব খারাপ সঙ্কেত দেয় দীর্ঘমেয়াদে," বলেন মাহবুবা নাসরিন।

"এটা সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়। কারণ যারা ধর্ষক, তারা মনে করে আমি ধর্ষণ করলাম এবং ভিকটিম নারীকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম," বলেন আইনজীবি শারমিন আক্তার।

তিনি বলেন, "বিয়েটাকে আদালতে জামিনের একটা গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করে তারা। তখন বিচারকরা দেখেন যে যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, তখন জামিন দিয়ে দেন। কিন্তু পরে এই মামলাগুলো আর এগিয়ে যায় না। কারণ ঐ আসামীর প্রতি মামলা চালানোর ইচ্ছাটা বাদীর আর থাকে না। কিন্তু মামলা চালু থাকে।

"কিন্তু যারা ভিকটিম তারা আর মামলা চালিয়ে যায় না। ফলে ঐ মামলাটা কখনোই আলোর মুখ দেখে না এবং এক সময় খারিজ হয়ে যায়।"

Share if you like

Filter By Topic