Loading...
The Financial Express

দিনে বাজারে যেতে ভয়, রাতে হামলার ভয়; কী করবে লামার ম্রো সম্প্রদায়?

| Updated: January 20, 2023 18:02:47


দিনে বাজারে যেতে ভয়, রাতে হামলার ভয়; কী করবে লামার ম্রো সম্প্রদায়?

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো পাড়ায় হামলা, অগ্নিসংযোগের পর পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও আতঙ্ক কাটছে না সেখানে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর।

মঙ্গলবার বিকালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার পাশাপাশি তিন পাড়ার বাসিন্দাদের চোখেমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। হামলা-ভাঙচুরের পর ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও অনেকে স্বাভাবিক হয়নি তাদের জীবনযাপন। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর এখনও তুলতে পারেননি, অন্য পরিবারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

পাড়াবাসী জানালেন, এখন দিনের বেলায় পুরুষদের বাজারে যেতে ভয় করে। কারণ পথে রবার কোম্পানির লোকজন নানাভাবে ‘হুমকি’ দেয়। আর রাতের বেলায় হামলার ভয়ে জেগে থাকেন, পাহারা দেন।

তবে লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা হুমকি দেওয়ার কথা অস্বীকার করে উল্টো ম্রোদের কাছ থেকে হুমকি পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।

গত ১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে রেংয়েন ম্রো পাড়ার তিনটি ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেঙে ফেলা হয় তিনটি ঘর। বাকি দুটি ঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে নগদ টাকা, ঘরের আসবাবপত্র ও গবাদিপশু লুট করা হয়।

এ ঘটনার জন্য ‘লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির’ লোকজনকে দায়ী করে মামলা করে পাড়াবাসী। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে বলছেন, তাদেরকে ফাঁসানোর জন্য নিজেরাই আগুন দিয়ে থাকতে পারে।

অগ্নিসংযোগ, হামলা ও ভাঙচুরের পর এরই মধ্যে সেখানে দুই দফা পরিদর্শনে গেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দল। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল দেখতে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ।

পরিদর্শনের সময় পাড়াবাসীদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ‘বলে দেওয়া হয়েছে’।

এরপরও পাড়াবাসীদের ভয় ও আতঙ্ক কাটছে না বলে জানান রেংয়েন পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়েন ম্রো।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিনের বেলায় হামলার কোনো ভয় নাই। কিন্তু রাত হলেই আতঙ্ক বাড়ে। পাড়ার সবাই ভয়ে থাকে রাতে আবার কোনো হামলা হয় কি না? প্রশাসন বলেছে, ভয় না পাওয়ার জন্য। তবু আতঙ্ক কাটছে না।

“প্রত্যেক রাতে দুই থেকে পাঁচজন করে একেক দলে পাহারা দিই আমরা। পাড়ার তিন দিকে তিনটি দল করে পাহারা দেওয়া হয়। নারী আর শিশুদের ঘুম যেতে দিই। রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত, কখনও ভোর পর্যন্ত আমরা পুরুষ সদস্যরা পাহারা দিয়ে থাকি, যাতে কোনো কিছু হলে আমরা জানতে পারি। অথবা নিরাপদ জায়গায় সরে থাকতে পারি।”

রেংয়েন ম্রো আরও বলেন, “আমাদের পাড়া থেকে আধা কিলোমিটার দূরে রবার কোম্পানির বাগানের সীমানা। সেখানে একটা টং ঘরে কোম্পানির লোকজন এসে থাকে। ওই জায়গায় রাতে সবসময় টর্চলাইট জ্বলতে দেখা যায়। একবার তো হামলা হয়েছে। আবার এমন কিছু ঘটবে না, তা বলা যায় না। এ কারণে ভয় ও আতঙ্কে পাড়ার কয়েকদিকে আমরা নিজেরাই পাহারা বসিয়েছি।”

পাড়াবাসী এখন দিনের বেলায় একা একা বাজারে যেতে ভয় পান। বিষয়টি সরই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকেও জানিয়েছেন।

তখন ইউপি চেয়ারম্যান কারা পথে ভয় দেখায়, তাদের নামের তালিকা দিতে বলেন।

রেংয়েন ম্রো বলেন, “রাবার কোম্পানির এত এত কর্মচারী। আমরা সবার নাম তো জানি না। কার নাম দেব?”

পাড়ার বাসিন্দা রেংয়ুং ম্রো বলেন, “এখনও আমরা বাজারে যেতে ভয় পাই। কোয়ান্টাম সড়ক দিয়ে সরই কেয়াজু বাজারে গেলে কাছে হয়। সময় কম লাগে। কিন্ত ওই রাস্তা দিয়ে গেলে রবার কোম্পানি লোকজন সবসময় থাকে। তারা সেখানে কাজ করতে আসে। ভয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাই।

“অথবা ঘরের মেয়েদের বাজারে পাঠাই। জরুরি প্রয়োজন থাকার পরেও আমরা পাঁচজনের কম হলে বাজারে যাই না। কমপক্ষে ছয়-সাতজন করে দলবেঁধে বাজারে যাই।”

একই পাড়ার আরেক বাসিন্দা সিংচং ম্রো বলেন, তিনটি পাড়া একই এলাকায় হলেও আমাদের রেংয়েন পাড়া অন্য দুটি পাড়া থেকে একটু দূরে। এ কারণে ভয়টা আরও বেশি। কিছু হলে কেউ এগিয়ে আসতেও অনেক সময় লাগবে।

লাংকম ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া মিলে সেখানে ২৮টি পরিবার রয়েছে। তাদের দুটি পাড়া পাশাপাশি রয়েছে।

হামলা-ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবার অন্য ঘরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান কারবারি রেংয়েন ম্রো।

তিনি জানান, তার ঘরে তিনটি পরিবারকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। আর পাশের নালে ম্রো তার ঘরে রয়েছে আরও দুই পরিবার। অন্য একটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে রেংওয়াই ম্রোর ঘরে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত বান্দরবান রেডক্রিসেন্ট পক্ষ থেকে কম্বল, চাল এবং আগুনে পোড়া তিনটি পরিবার ছয় বান ঢেউটিন, বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ‘গ্রাইস’র পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছে। কক্সবাজারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চাল, ডাল, আলু, লবণ সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান পাড়াবাসী।

পাড়াবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে সরই ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, পাড়ায় হামলার দুদিন পর কারবারি একবার বলছিলেন, তারা বাজারে আসতে ভয় পান। পাড়াবাসীদের রবার কোম্পানির কারা ভয় দেখায় তাদের একটা তালিকাও দিতে বলা হয়েছিল। তারা দেয়নি।

“এরপরও রবার কোম্পানির লোকজনদের বলে দেওয়া হয়েছে ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীর কাউকে কোনোভাবে ভয় বা হয়রানি করা যাবে না।”

সরই ইউনিয়নের কেয়াজু বাজার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেংয়েন ম্রো পাড়ায় ১ জানুয়ারি ঘটনার পর সবসময় পুলিশের নজরদারি রয়েছে। পুলিশের মুভমেন্ট রয়েছে। পাড়াবাসীদের বাজারের রাস্তায় কেউ কিছু করবে এখনও এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

“জায়গা নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে। তাই বলে বাজারে কাউকে রাস্তায় আটকে রাখবে- এরকম কিছু কেউ করতে পারবে না।”

লামা রবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির পরিচালক ইফতেখায়ের আলম চৌধুরী ম্রো পাড়ার বাসিন্দাদের কোনো ধরনের হুমকি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ম্রোদের হুমকির মুখে আমাদের রবার কোম্পানির অনেক কর্মচারী ওই পাড়া সংলগ্ন বাগানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ভয়ে কয়েকজন কর্মচারী এরই মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। আর আমাদের কর্মচারীরা তাদের কেন বাজারের পথে হুমকি দিতে যাবে?”

“এখানে এত এত টাকা বিনিয়োগ করে আমরা নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছি মনে হচ্ছে। ভয়ে ওই এলাকায় কেউ কাজ করতে যেতে চাচ্ছে না,” বলেন রবার কোম্পানির পরিচালক। 

Share if you like

Filter By Topic