বাজারে ডিম নেই, সুপার শপ কিংবা দোকান সবখানেই ঝুড়ি খালি; কিছু থাকলেও দাম অনেক বেশি। এই পরিস্থিতি চলছে নিউ জিল্যান্ডে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
দেশটির বাসিন্দারা তাই ডিম পেতে বাড়িতে মুরগি পালনের দিকে ঝুঁকছে বলে সিএনএন জানিয়েছে, যাতে বাড়ির আঙিনাতে সহজে মুরগি পেলে পরিবারের সবার ডিমের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
গত বছরে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে ডিমের দাম, কোনো কোনো দেশে দাম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে সিএনএন দেখেছে, বিভিন্ন সময়ে বার্ড ফ্লুতে প্রচুর মুরগি মারা গেছে। আর রাশিয়া ও ইউক্রেইনের যুদ্ধ এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা নিষেধাজ্ঞায় পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে মুরগির ডিমে।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ডিমের দাম অন্যান্য নিত্যপণ্যকে ছাড়িয়ে যায় গত বছরে। বলা হচ্ছে, ২০২১ সালে ডিমের দাম বেড়েছে ২০২০ এর তুলনায় শতকরা ৬০ শতাংশ। জাপানে ডিমের পাইকারি দামও রেকর্ড উচ্চতায়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিউ জিল্যান্ডের মানুষের খাদ্য তালিকায় ডিমের ব্যবহার বেশি। দেশটিতে মুরগি পালনের নিয়মে কিছু পরিবর্তন আনায় ডিমের সরবরাহ কমেছে এবং ডিমের দামও বেড়েছে। এই ঘাটতিতে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বড় বিপাকে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে তাদের পরিকল্পনা হল বাড়িতে মুরগি পালন করা; আর এ জন্য দ্বিগুণ দাম দিয়ে হলেও অনলাইনে মুরগি কিনছেন তারা।
নিলাম ওয়েবসাইট ট্রেড মিতে গত মঙ্গলবার মুরগির বাচ্চা এবং পালনের সামগ্রীর চাহিদা আগের মাসের চেয়ে ১৯০ শতাংশ বেশি দেখা যায়।
কোম্পানির মুখপাত্র মিলি সিলভাস্টর বলেন, “জানুয়ারির শুরু থেকে আমরা ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ মুরগির বাচ্চা, আর মুরগির খাবারসহ এই সংক্রান্ত পণ্য চাইছেন।”
“সব মানুষ এখন বাড়িতে মুরগি পালতে চাইছেন, কারণ তারা ডিম কেনার সামর্থ্য হারিয়েছেন,” বলেন ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দা রোন ফন টিল। এই বেকারি মালিক বলেন, তার বোন এখন ট্রেড মি’তে মুরগির বাচ্চা বিক্রিতে নেমেছেন এবং দামও পাচ্ছেন আগের দ্বিগুণ।
ডিম উৎপাদনকারীরা জানান, বাজারের চাহিদা মেটাতে তাদের কয়েক হাজার মুরগির অভাব রয়েছে। তাই ডিম সংকট মোকাবেলায় কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।
দেশটির পরিচিত সুপারমার্কেট চেইন ‘ফুডকাস্টার’ সম্পতি গ্রাহক প্রতি ডিম কেনায় সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
‘ফুডকাস্টার’র জনসংযোগ প্রধান এমা উস্টার বলেন, “সরকার এই শিল্পে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। ডিমে অফার বাড়াতে আমরা সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। আপাতত আমরা ক্রয় সীমা নির্ধারণ করেছি।”
মুদি পণ্যের খুচরা বিক্রেতারা জানান, ডিম বিক্রিতে সরকারি কোনো বেঁধে দেওয়া নেই। তবে নতুন নিয়ম গ্রাহকদের আপনাআপনি প্রয়োজনের বাইরে ডিম কিনতে নিরুৎসাহিত করছে।
বেকারি মালিক রোন ভ্যান টিল বলেন, “আমি তো কেক আর মাফিন বানাতে গিয়ে বিপদেই পড়েছিলাম। হাতে ডিম কম ছিল।”
ডিম সরবরাহের ঘাটতিতে যেসব খাবারে ডিমের ব্যবহার অপরিহার্য ছিল, সেগুলোর রেসিপিতে পরিবর্তন আনার কথাও ভাবছেন তিনি।
‘রাঙ্গিওরা’ নামের আরেক বেকারির মালিক জানান, পাইকারি ডিমের দাম গত চার মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা তাকে ভাবাচ্ছে।
কিছু ক্যাফে তাদের খাবারের মেন্যুতে জানিয়ে দিয়েছেন, নাস্তায় পাঁচটি ডিমের বদলে দুটো ডিম নিতে হবে। তবে আরও ভালো হয় গ্রাহকরা যদি প্যানকেক বা অন্য খাবার নেন।
সংকটের মূল যেখানে
নিউ জিল্যান্ডে ব্যাটারিযুক্ত খাঁচায় মুরগি পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা এবছরই কার্যকর হয়েছে। আর সেটাই ডিম সংকটের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় ব্যাটারিযুক্ত খাঁচায় মুরগি রেখে ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
ধাতব এই খাঁচায় মুরগিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে তার স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করা নিয়ে আপত্তি ছিল প্রাণী অধিকারকর্মীদের। তাদের দাবির মুখে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দেয় নিউ জিল্যান্ড সরকার, ডিম উৎপাদকদের ভিন্ন চাষ পদ্ধতি খুঁজে নিতে এক দশক সময়ও পার করে।
নিউ জিল্যান্ডে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি পিটার হাইড সিএনএনকে বলেন, উৎপাদকদের খাঁচা, মুরগির খাবার এবং ব্যাটারিযুক্ত খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন না করে বিকল্প পথে যাওয়ার রাস্তা ছিল। মন্ত্রণালয় নতুন নিয়ম শুরুর আগে গত ১৮ মাস ধরে খামারিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, খামার পরিদর্শনও করেছে।
তবে তাতে যে কাজ হয়নি, এই সংকটই তার প্রমাণ। কারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে অনেক খামারি মুরগি পালন ছেড়ে দিয়েছেন।
পরিবেশবাদীদের নতুন উদ্বেগ
ডিমের জন্য মুরগির পেছনে মানুষের ছোটায় নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে পরিবেশবাদীদের মধ্যে। তারা বলছেন, মুরগি একটি প্রাণী, এটি কেবল ডিম পাড়ার যন্ত্র নয়। ডিমের জন্য অকারণ প্রাণিদের উপর জুলুম করা যাবে না।
নিউজিল্যান্ডের সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলিটি টু অ্যানিমেলসের (এসপিসিএ) প্রধান নির্বাহী গ্যাবি ক্লেজি বলেন, মুরগি বেঁচে থাকে অনেক দিন। এর আয়ু সাধারণত এর জাতের উপর নির্ভর করে। জীবনের এই মেয়াদ ১০ বছরও হয়ে থাকে কখনও কখনও।
তার ভাষ্যে, তবে তার মানে এই নয় যে মুরগি তার সারাটা জীবন ধরে ডিম দিয়েই যাবে। ডিম পাড়ার প্রবণতা মুরগির বয়স, পরিবেশ এবং স্থানীয় জলবায়ুর উপরে নির্ভর করে।
“সুতরাং কেউ যদি মুরগির বাচ্চা কিনে নিয়েই মনে করেন, সেটি বড় হয়ে তাদের বাড়ির জন্য ডিমের স্থায়ী সরবরাহকারী হবে, তাহলে তারা ভুল করবেন।”
‘ট্রেড মি’ও তাদের গ্রাহকদের মুরগি কেনার ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা পরামর্শ দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও ভাবছেন। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, খাঁচায় মুরগি পালন এবং ডিম পাড়ার সময় মুরগির বিশেষ যত্ন নিতে হবে, যাতে কোনো ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ না হয়।
এছাড়া মুরগি পালনে ‘অতিউৎসাহী’ হয়ে মুরগি কেনার জন্য বাজার অস্থিতিশীল না করতেও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।