কৃষককে ১৫ টাকা কেজি দরে এমওপি সার দিচ্ছে সরকার; রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের পর যা বিদেশ থেকে কিনতে ১২০ টাকা পর্যন্ত দরও দিতে হয়েছিল। তবে গত কয়েক মাস থেকে তা ধাপে ধাপে নিম্নমুখী হওয়ায় সরকারি কোষাগারে চাপ কমছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
এই সারের পাশাপাশি বিশ্ববাজার থেকে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সার সংগ্রহের বাড়তি দামও একইভাবে কমতির দিকে হওয়ায় এ খাতে হঠাৎ ব্যয়ের যে উল্লম্ফন হয়েছিল তা থেকে এখন স্বস্তি পাওয়ার আশায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
শস্য উৎপাদনে সারের জোগান দিতে গিয়ে সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার যে শঙ্কা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তা কিছুটা কমে আসছে বলে মনে করছেন তারা। কর্মকর্তারা বলছেন, দাম কমার বর্তমান প্রবণতায় ভর্তুকির চাপও কমে আসবে।
আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার আমদানির জন্য সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন হওয়া দরের তথ্যে দেখা যায়, যুদ্ধের কারণে প্রতি কেজি ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকা এমওপি সারের দাম গত ছয় মাস ধরে কমে ৬৯ টাকায় নেমেছে।
অন্যান্য সার কেনার বেলাতেও গত তিন থেকে চার মাস ধরে ধারাবাহিক নিম্নমুখী অবস্থা দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দাম কমেছে।
ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে অনুমোদন হওয়ার সারের সবশেষ ক্রয়মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে সারের ক্রয়মূল্য গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গড় মূল্যের চেয়ে কিছুটা কমে এসেছে।
কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হওয়ায় গত ছয় মাস ধরে আগের চেয়ে কম দামে সার সংগ্রহ করা যাচ্ছে। দাম কমার এ প্রবণতা ভর্তুকির ওপর নিশ্চিতভাবে চাপ কিছুটা কমাবে।
যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফসল উৎপাদন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়ায় এটি সবার জন্য ‘স্বস্তির’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আগে সারের দাম অনেক চড়লেও তা কৃষকের জন্য শঙ্কা সৃষ্টি করেনি। কারণ সরকার এ ক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সব মৌসুমে কৃষকের কাছে পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করা হয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমেও প্রয়োজনীয় সারের ব্যবস্থা সরকার করে রেখেছে।“
২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে কোভিড মহামারীর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হতে শুরু হলে সার, তেল, গ্যাসসহ আন্তর্জাতিক বাজারে বেচাকেনা হয় এমন অনেক পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। পরে এতে যোগ হয় ২০২২ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব।
সুলভমূল্যে কৃষকের কাছে সার বিক্রি করতে গিয়ে সরকার আগের বছরগুলোতে সাধারণত প্রতি বছর গড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে এলেও এ দুই কারণে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়।
তখন ভর্তুকির চাপ কমাতে সারের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে। সবশেষ গত অগাস্টে সরকার ইউরিয়া সারের খুচরা মূল্য ৬ টাকা বাড়িয়ে ২২ টাকা করে। আর আগের দরেই প্রতি কেজি টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা ও ডিএপি ১৬ টাকায় কৃষককে দিচ্ছে সরকার।
অথচ সর্বশেষ কেনাকাটার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি কেজি ইউরিয়া ৬৩ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা, এমওপি ৬৯ টাকা ও ডিএপি ৭১ টাকা ৭১ পয়সায় কিনছে সরকার।
এসব সারের দাম গত ২০২১-২২ অর্থবছের টানা বেড়ে গড়ে প্রতিকেজি ইউরিয়া ৯৬ টাকা, টিএসপি ৭০ টাকা, এমওপি ৫৪ টাকা ও ডিএপি ৯৩ টাকায় দাঁড়িয়েছিল।
কৃষি সচিব বলেন, “দাম কমার এখনকার প্রবণতা বজায় থাকলে ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসবে। গত জুলাই মাসে সব ধরনের সারের দামই ছিল আকাশচুম্বি। সেই সময় প্রতিকেজি ১২০ টাকা দরে এমওপি সার কিনতে হয়েছিল। পরে দাম ধীরে ধীরে প্রায় অর্ধেক কমেছে। এর একটা সুফল আমরা তো অবশ্যই পাব।”
বিশ্বে দুর্লভ এমওপি সারের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা বিবেচনা করা হয় রাশিয়াকে। এর বাইরে কানাডা ও বেলারুশের খনিতে এই সার পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এমওপি সার পাওয়া গেলেও তা পরিমাণে কম।
তবে গত ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেইনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে এমওপি সারের দাম বাড়তে শুরু করে।
তখন সরকার তড়িঘড়ি করে কানাডার সঙ্গে বছরে ৫ লাখ টন এমওপি সার কেনার রাষ্ট্রীয় চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরের সার কেনা শেষ হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া মিলিয়ে ৬৬ লাখ টন সার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ, ডিএপি ১৬ লাখ এবং টিএসপি ও এমওপি সাড়ে সাত লাখ টন করে লাগে।
ধাপে ধাপে কমছে দাম
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়ার আমদানি ব্যয় ছিল ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা। এ ব্যয়ের ওপর ভর করে সরকারকে বছর শেষে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছিল।
পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে নিকট অতীতের মধ্যে তা অকল্পনীয় পরিমাণ বাড়লে সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হয় ২০ হাজার কোটি টাকার মত; মোট ভর্তুকি বাবদ খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
সবশেষ দরের সঙ্গে গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গড় ক্রয় মূল্যের তুলনায় দেখা যায়, বর্তমানে কেজিতে ইউরিয়ার দাম ৩৩ টাকা, টিএসপি ২০ টাকা ও ডিএপি ২২ টাকা কমেছে। তবে গত অর্থবছরের গড় দামের তুলনায় এমওপি কেজিতে ১৫ টাকা বেড়েছে।
ক্রয় কমিটির বুধবারের বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে কানাডা থেকে ১০ম ও ১১তম (বছরের শেষ লট) মোট এক লাখ টন এমওপি সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান।
তিনি জানান, এমওপি সার কিনতে আগের ধাপে প্রতিটন ৬৭৯ দশমিক ৬৫ ডলার করে খরচ হলেও এবার তা কমে গিয়ে ৬৫৫ দশমিক ৩ ডলারে নেমেছে।
বৈঠকের আলোচ্য সূচি থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির আওতায় কানাডা কমার্শিয়াল করপোরেশন থেকে ৬ কোটি ৫৫ লাখ ৩ হাজার ডলার বা ৬৮৯ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকায় মোট এক লাখ টন এমওপি সার কেনার প্রস্তাব করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। কমিটি এই প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে।