কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারে ভারতের অনুমতি নেওয়া ‘অনৈতিক’: খালেকুজ্জামান


FE Team | Published: September 17, 2022 20:27:07 | Updated: September 18, 2022 17:58:00


কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারে ভারতের অনুমতি নেওয়া ‘অনৈতিক’: খালেকুজ্জামান

কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের যৌক্তিকতা দেখছেন না নদী বিশেষজ্ঞ মো. খালেকুজ্জামান।

তিনি বলেছেন, “শুকনো মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বাংলাদেশ অংশে গড়ে ৫,২৯৫ থেকে ১৭,৬৫০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। সেই তুলনায় ১৫৩ কিউসেক পানি নিতান্তই সামান্য পরিমাণ (১ থেকে ৩ শতাংশ)। এই সামান্য পরিমাণ পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করার জন্য বাংলাদেশকে যদি ভারতের অনুমতি নিতে হয়, তা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।

শনিবার দুপুরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিশ্লেষণমূলক সাময়িকী সর্বজনকথা আয়োজিত ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎশীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ৬ সেপ্টেম্বর যে সাতটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেটির একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার সম্পর্কিত। এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খালেকুজ্জামানের মতে এই সমঝোতা স্বাক্ষরটিও ‘অসংগতিপূর্ণ। এর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, কুশিয়ারার যে অংশের জন্য সমঝোতা হয়েছে, সেই অংশটি পুরোপুরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত।

এই পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ বলেন, “রহিমপুর খালের কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে কুশিয়ারা নদীর ভারতের অংশে ‘নোম্যান্স ল্যান্ডেনোটি খালের গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে একটি জনপদ তৈরি করা হয়েছে, সেজন্য ভারতের বাংলাদেশের অনুমতি নেওয়ার দরকার হয়েছিল বলে জানা যায় না। এই নোটি খালটি বহমান থাকলে বরং শুকনো মৌসুমে কুশিয়ারাতে পানিপ্রবাহের পরিমাণ আরও বাড়ত।

সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “এবারের চুক্তিটার যে সাফল্য বলা হচ্ছে, এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কেন মাত্র ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করবে বাংলাদেশ? ভারতের কাছ থেকে কেন অনুমতি নিতে হবে?”

ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইনে সমাধানের আহ্বান জানান তিনি।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইন যেটা আছে, সেটাতে বাংলাদেশ কেন স্বাক্ষর করে নাই, এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটা খুব দরকার। ওই আইনে একটা বিধিমালা আছে, কীভাবে নদীর পানি বণ্টন হবে। সেই হিসেবে এটাকে ভাটির দেশের নিরাপত্তার সনদ বলা যায়।

এটাতে বাংলাদেশের সরকার অবশ্যই স্বাক্ষর করতে হবে, ভারতও যাতে করে সেটার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী যাতে ভারত ও চীনের সঙ্গে সমস্ত নদীর পানি সমস্যার নিষ্পত্তি হয়, সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে টেকসই সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

জাতিসংঘের অধীনে সীমান্ত হত্যার তদন্ত করার দাবি জানিয়ে ‘সর্বজনকথাসম্পাদক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত সরকার তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বারবার ভঙ্গ করছে। দুদেশের মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সীমান্ত হত্যা বন্ধের পাশাপাশি ফেলানী ও মিল্টনসহ সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিষয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অযৌক্তিভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। অথচ তেল পরিশোধন, গ্যাস অনুসন্ধান এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আর্থিক, পরিবেশগত ও জ্বালানি সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করায় ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারতকে দেওয়া ট্রানজিটকে কেন্দ্র করে নানা অবকাঠামোগত প্রকল্প চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সর্বশেষ প্রস্তাব হিলি থেকে মেঘালয় মহাসড়ক ও সেতু। এসব প্রকল্পে বাংলাদেশের সামাজিক, পরিবেশগত, নিরাপত্তাজনিত ক্ষতি বা ঝুঁকি এখনও বাংলাদেশের মানুষ জানে না। এ বিষয়ে সকল তথ্য জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে অবিলম্বে এ বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান বলেন, বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০২২ পর্যন্ত সীমান্তে ১৬১ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে মারা গেছে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সীমান্তে এরকম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১২৫৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তা অব্যাহতই থাকছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সফরকালেই দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হলেন ১৭ বছরের স্কুল শিক্ষার্থী মিনাহাজুল ইসলাম মিল্টন।

ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো বাস্তবায়নের জন্য সীমান্তের সমন্বিত বা যৌথ ব্যবস্থাপনার আওতায় যতটা তৎপরতা দেখা যায়, সীমান্ত হত্যা বন্ধের ক্ষেত্রে সেরকম কোনোকিছু দেখা যায় না।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দিন দিন ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, “বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, ভারত থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি করলে ব্যারেল প্রতি বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে ২ থেকে ৩ ডলার। অন্যদিকে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে দেশের পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়িয়ে সেখানে পরিশোধন করে ডিজেল উৎপাদন করা হলে সাশ্রয় হত ব্যারেল প্রতি ১১ ডলার।

ভারত থেকে তেল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে ২০১৭ সাল থেকে, অথচ ২০১২ সালের ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প এখনও ঝুলে আছে।

এই জ্বালানি গবেষক বলেন, “পেট্রোবাংলা অগভীর সমুদ্রের এসএস ০৪ এবং এসএন ০৯ ব্লকের জন্য ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের পিএসসি সই করে ভারতের ওএনজিসির সাথে। ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষ হবার পর চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়; কিন্তু কাজ হয়নি। অথচ পেট্রোবাংলার সক্ষমতা বাড়িয়ে সমুদ্রে কাজ শুরু করলে এতোদিনে গ্যাস পাওয়া যেত।

সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।

Share if you like