সাগরে মাছ ধরা শেষে তীরে ফিরছিল ‘এফবি মা-বাবা’; শুক্রবার রাতে কুতুবদিয়া গ্যাস ফিল্ডের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ২০-২৫ জনের একটি দল কয়েকটি বোটে করে এসে ঘিরে ফেলে ট্রলারটি। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের মুখে ট্রলারে থাকা ইলিশ, তেল, মোবাইল আর টাকা-পয়সা লুটে নিয়ে যায়।
একই রাতে হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলের কালিরচর অংশেও একযোগে পাঁচ-ছয়টি মাছ ধরার ট্রলারে জলদস্যুরা হামলা চালায়। বোট মালিক আর মাঝিরা বলছেন, প্রাণভয়ে বসে বসে থেকে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তাদের।
এফবি মা-বাবার মাঝি আবদুল আজিজ বলেন, “হামলাকারীরা কথা বলতেছিল হাতিয়া-নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষায়। আমাদের সামনে একটা বোট ছিল। আর পিছনে দুইটা বোট। সেগুলো থেকেও সবকিছু নিয়ে গেছে।”
মূলত ইলিশ মাছ, বোটের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, জাল, জেলেদের হাতে থাকা মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নিতে মাঝ সাগরে জলদস্যুরা এভাবে হামলা করছে বলে জানালেন তিনি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
মৎস্যজীবী ও বোট মালিকরা বলছেন, ইলিশের ভরা মওসুমে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী-মাতারবাড়ি-কুতুবদিয়া-বাঁশখালী-সাঙ্গুর মুখ-আনোয়ারা এবং সন্দ্বীপ-হাতিয়া অংশে এই উৎপাত সম্প্রতি বেড়েছে।
আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সাগরে লুট হওয়া মাছ সাগরেই বিক্রি হয়। জেলেদের মধ্যে কোন্দলের জেরেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে কোস্টগার্ডের সন্দেহ।
শুক্রবার রাতে কুতুবদিয়া অংশে ডাকাতের কবলে পড়া একটি ফিশিং বোটের লোকজন ৯৯৯-এ ফোন করে বিষয়টি জানায়।
পরদিন সকালে নগরীর ফিশারিঘাটে ফিরে অন্য কয়েকটি বোটের লোকজনও জলদস্যুদের আক্রমণের কথা বলে। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দিয়ে নৌ পুলিশকেও তারা জানায় বিষয়টি।
নৌ পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, “বোট মালিক সমিতি জানিয়েছে, নয়টি বোটে ডাকাতি হয়েছে। আমরা চাটি বোটের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সেদিন গভীর সাগরে হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলের কালিরচর অংশ আর অন্যদিকে কুতুবদিয়া চ্যানেলে মোট প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল জুড়ে এই দস্যুতার ঘটনা ঘটে। তখন অমাব্যসার জো ছিল। মূলত ইলিশ মাছ ধরে ফেরার সময় বোটগুলোতে হামলা চালানো হয়।
‘টার্গেট’ ইলিশ
সাগরে দস্যুতা নতুন নয় জানিয়ে ফিশারিঘাট বোট মালিক সমিতির কার্যকরী সদস্য মনির আহমদ বলেন, তাদের আটটি বোট গভীর সাগরে মাছ ধরে। ২০১৮ সালে সুন্দরবন এবং চট্টগ্রাম উপকূলে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানের পর কয়েকবছর পরিস্থিতি ভালো ছিল।
“কিন্তু পরে আবার শুরু হয়েছে। গত বছর মে মাসে আমার বোট গভীর সাগরে আটকে ফেলে ডাকাতরা। মাঝিকে হত্যার হুমকি দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। কয়েক জনের মারফত যোগাযোগ করে মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে বোট ছাড়াতে হয়।
“তবে এবার বোট আটকাচ্ছে না। বোটের মাছ, তেল, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, বোটের লোকজনের হাতে থাকা স্মার্টফোন, টাকা এমনকি ভালো কাপড়চোপড় পেলে সেগুলোও নিয়ে যাচ্ছে।”
মাছ ধরতে সাধারণত ১৫-২০ জন জেলে নিয়ে পাঁচ থেকে ২০ দিনের জন্য সাগরে যায় মাঝারি আকারের ফিশিং বোটগুলো। এর মধ্যে কিছু ট্রলার উপকূলের কাছাকাছি ছোট আকারের ইলিশ ধরে। আর কেউ গভীর সাগরে চলে যায় মাছ ধরতে।
এফবি সাইফুল নামের ফিশিং বোটের মাঝি মো. মেলিম ভোলার মনপুরার বাসিন্দা। সোমবার চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে আলাপকালে সেলিম জানান, গতবছর মাঝিদের মারধর করে তার বোটের মাছও একইভাবে নিয়ে যায় দস্যুরা।
“তাদের হাতে পিস্তল, কিরিচসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র থাকে। অস্ত্রের মুখে লোকজনকে আটকে ফেললে সাগরে আর কিছু করার থাকে না। গত শুক্রবার কুতুবদিয়ার ওদিকে মনপুরার দুটি বোটের মাছ নিয়ে গেছে বলে খবর পেয়েছি।”
সাগরের বাঁশখালী অংশে মাছ ধরে সোমবার দুপুরে ফিশারিঘাটে ফেরেন ফিশিং বোটের মাঝি আশরাফ মিয়া। তিনি বলেন, “সাগরে মাছ নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর রাতে ফেরার সাহস করিনি আর। আজকে ভোরে তিনটা বোট একসঙ্গে রওনা দিছি।
“বাঁশখালী, সাঙ্গুর মুখ আর আনোয়ারার পারকির চরের একটু দূরে দস্যুরা অপেক্ষায় থাকে। একা বোট পেলে তারা হামলা করে।”
চলতি বছর এবং গত বছর ইলিশের মৌসুমে সাগরে এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি জেলে ও বোট মালিকদের। তবে এবার নয়টি বোট একসঙ্গে ডাকাতের কবলে পড়ায় মাঝিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
বোট মালিকদের দাবি, প্রতি ট্রিপে বোটের আকার ও গন্তব্য ভেদে দেড় থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। শুক্রবার নয়টি বোটের সবগুলো থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে গেছে দস্যুরা। মাঝারি আকারের এসব বোটে গড়ে ৩০ থেকে ৫০ মণ করে ইলিশ ধরা পড়ে, যার সবই হারাতে হয়েছে।
সক্রিয় একাধিক দল
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সাগরের বিস্তৃত অংশজুড়ে দস্যুতায় একাধিক দল সক্রিয় বলে তাদের ধারণা।
নৌপুলিশের ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, “যারা ঘটনার শিকার হয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পেয়েছি একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। শুক্রবার রাতে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় কাছাকাছি সময়ে ঘটনা ঘটেছে, যা এক গ্রুপের পক্ষে সম্ভব নয়।
“এর মধ্যে নোয়াখালী-হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেল, বাঁশখালী-আনোয়ারা অংশ এবং কুতুবদিয়া চ্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ জড়িত বলে ধারণা পেয়েছি।”
এক বোট মালিক বলেন, আগে যখন দক্ষিণবঙ্গে এবং বাঁশখালী-আনোয়ারা-কুতুবদিয়ার ডাকাতরা বোটে হামলা করত, তাদের কাছে দোনলা বন্দুক থেকে শুরু করে নানা রকম অস্ত্র থাকত। ২০১৮ সালে র্যাবের অভিযানে তারা কেউ কেউ মারা যায়। অনেকে গ্রেপ্তার হয়।
“এখন যারা বোটে ডাকাতি করে তাদের তেমন অস্ত্র নেই। স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়েই তারা বোট লুট করছে।”
বোট মালিক সমিতির মহাসচিব আমিনুল হক বাবুল সরকার বলেন, শুক্রবার নয়টি বোট দস্যুদের যেসব দলের কবলে পড়েছিল, তাদের অধিকাংশই বাঁশখালী-আনোয়ারা অংশের বলে ভাষা শুনে মনে হয়েছে। আগে যারা ধরা পড়েছিল, তারাও জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে জড়িয়ে থাকতে পারে।
“এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দস্যুতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কোস্টগার্ড টহল বাড়ালে এরকম ঘটনা কমে যাবে।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নৌপুলিশের ওসি মিজানুর রহমান বলেন, “সাগরের এসব অংশে মূলত কোস্টগার্ড কাজ করে। তারপরও আমরা খোঁজ নিচ্ছি। কিন্তু লুট করা এসব মাছ ঘাটগুলোতে আসে না। এগুলো সাগরেই বিক্রি হয়। অন্য বোট মালিকরা কম দামে কিনে নেয়।”
আর কোস্টগার্ডের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার কাজী শাহ আলম বলেন, “সাগরে আমরা টহলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছি। সাড়াশি অভিযান চলছে (দস্যুতার বিরুদ্ধে)।
“তবে যে ঘটনার কথা বলছেন, এটাতে তাদের অন্তর্কোন্দল থাকতে পারে- এরকম তথ্যও আমরা পেয়েছি। তাদের অভিযোগ কতটা সত্য তা যাচাই করা হচ্ছে।”