Loading...

অনিওম্যানিয়া: কেনাকাটা যখন রূপ নেয় রোগে

| Updated: June 04, 2022 12:19:20


ছবি: অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিকাল সোসাইটি ছবি: অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিকাল সোসাইটি

আরে ওর কেনাকাটার বাতিক রয়েছে। যা দেখে, তাই কিনে। শুধু কেনাকাটা আর কেনাকাটা,’ বেশ শোনা একটি কথা। শাকসবজি থেকে শুরু করে পরিধেয় বস্ত্র, প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করা দৈনন্দিন জীবনেরই একটি অনুষঙ্গ। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনটা অনেকটা নেশায় বা আসক্তিতে পরিণত হয়।  

কোনো কিছু দেখলেই যেন তা কেনা চাই। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক কিছু না কিছু কিনতেই হবে। এটি কি নিছকই কোনো বাতিক নাকি কোনো ধরনের রোগের ইঙ্গিত?

কেনাকাটা করতে সবাই ভালোবাসে তবে তা অকারণে বা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠলে একদিকে যেমন আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি করে একই সাথে তা এক ধরনের মানসিক সমস্যায় রূপ নেয়। এই সমস্যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় ‘কমপালসিভ বায়িং ডিজঅর্ডার’ বা ‘অনিওম্যানিয়া’। 

এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে ‘শপাহোলিক’ এবং ‘অনিওম্যানিয়াকের’ মধ্যে পার্থক্যটা জেনে নেওয়া দরকার। যুক্তরাজ্যের বহুল পঠিত সংবাদপত্র ‘মেট্রো’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সিনিয়র থেরাপিস্ট এবং লেখিকা, স্যালি বেকার এ দুইয়ের পার্থক্য তুলে ধরেন।

যাদেরকে শপাহোলিক বলা হয় তারা সাধারণত তাদের কেনাকাটার পুরো বিষয়টাকে উপভোগ করেন। হয়তো হঠাৎ কখনো কখনো তালিকা বা পরিকল্পনার বাইরেও কিছু কিনে ফেলেন। তবে কিনে ফেলার এই প্রবণতা বা ইচ্ছেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বাড়তি কিছু কিনে ফেললে পরবর্তীতে কেনাকাটা করার সময় সেই বাড়তি খরচকৃত অর্থের পরিমাণকে পুষিয়ে নেন।

কিন্তু অনিওম্যানিয়াকের ক্ষেত্রে চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। মূলত যাদের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর আবেগ কাজ করে, যেমন - দুশ্চিন্তা, অবসাদ তারা তাদের এই অনুভূতি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে অনেকসময় নিয়মিত এবং অযথা কেনাকাটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ খরচের সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলোও তাদের চিন্তায় আসে না।

কেনাকাটার সময়টুকুতে তারা বেশ ফূর্তি মেজাজেই থাকেন, কিন্তু ফিরে আসার পর আবার সেই হতাশা, দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। যার ফলে এ থেকে মুক্তির আশায় তারা আবারো কেনাকাটায় নিজেদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। অনেকটা সাইক্লিক অর্ডারের মত করে এই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।

পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা প্রায় ৯ গুণ বেশি।

ফ্যাশন ডিসকাউন্টসে প্রকাশিত তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ অনিওম্যানিয়ায় আক্রান্ত। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ - ১৬% মানুষ এই রোগে ভুগছে আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ - ৮%।

এক জরিপে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৭% এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩.৫% মানুষ কেনাকাটার পর এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, ‘এটা কেন কিনলাম?! এটা না কিনলেও তো পারতাম! অযথা শুধু শুধু কতগুলো টাকা খরচ করলাম!

অনিওম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত কোনো সঙ্গীর চেয়ে একাকী কেনাকাটা করতেই বেশি পছন্দ করেন। অহেতুক কেনাকাটার এই অভ্যাসের কারণে এই মানুষগুলো প্রায়শ তাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি সহকর্মীদের কটুক্তির পাত্র হয়ে উঠেন।

যেহেতু এটি কোনো জন্মগত বা বংশগত রোগ নয় তাই কেনাকাটা জনিত এমন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে জানা থাকলে হয়তো সময় থাকতে সচেতন হওয়া সম্ভব।

আত্মবিশ্বাসের অভাব এই রোগের একটি কারণ হতে পারে। দুঃখ, হতাশা, রাগ, বিরক্তি বা ভীতি-এই ধরনের অনুভূতিগুলো অনেকটা উইপোকার মতো ভেতর থেকে মানুষের আত্মবিশ্বাসকে কুড়ে কুড়ে খায়। নিজেকে অনেকটা অর্থহীন মনে হয়। কেনাকাটা করার সময় কিছু সময়ের জন্য এই অনুভূতিগুলো চাপা পড়ে যায়, আর ভালো লাগার অনুভূতি থেকেই একজন ব্যক্তি অনেকটা জ্ঞানশূণ্য হয়ে কেনাকাটায় মগ্ন হয়ে পড়েন।

কিছু মানুষ থাকে যারা খুব সহজেই সবকিছু মেনে নেয়, সহানুভূতিশীল এবং কোমল মনের অধিকারী। এই মানুষগুলোকে যেকোনো ব্যাপারে রাজি করানো খুব সহজ। একা একা কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে এমন স্বভাবের কারণে প্রভাবিত হয়ে পড়েন।

 আরো আছে আবেগজনিত সমস্যা বা মুড সুইংও বলা যেতে পারে। দীর্ঘদিনযাবত বিষন্নতা এবং উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন এমন একজন তার ব্যক্তিজীবনে প্রচন্ড রকম অসুখী হওয়ার কারণে বিকল্প হিসেবে পার্থিব জিনিসের মধ্যে সুখ খুঁজে নিতে শুরু করেন। নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনাকাটায় তারা সুখ খুঁজে পান, যদিও তার স্থায়ীত্বকাল খুব সাময়িক।

অনেকেই নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আবেগ খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। হুট করে কোনো কিছু করতে ইচ্ছে করতেই পারে। তবে কিছু মানুষ এই ধরনের অনুভূতি বা আবেগ বিশেষত কোনো কিছু কেনার বিষয়টি হুট করে মাথায় এলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, সেই মুহূর্তেই কেনা চাই-ই চাই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনের বিষয়টি উহ্য রয়ে যায়।

মানুষ মাত্রই কল্পনাপ্রবণ। তবে কিছু মানুষ যেন একটু বেশিই কল্পনার জগতে বিচরণ করে। এমনকি কোনো কাজ করার পাশাপাশিও তারা ভাবতে থাকে - আচ্ছা ঐ ড্রেসটায় আমায় কেমন মানাবে, ঐ ডিজাইনের কাপড়গুলো কিন্তু দেখতে বেশ, ওদের ‘অফার’ তো প্রায় শেষ হতে চললো। এই জল্পনা - কল্পনাগুলো মাত্রাতিরিক্ত কেনাকাটার প্রবণতা তৈরি করে।  

শবনম জাবীন চৌধুরী ইউনিভার্সিটি  অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic