রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ৬০ ফিট রাস্তার আমলিরটেক মোড় থেকে একটু বা দিকে গেলে চোখে পড়বে গোপাল চন্দ্র শীলের সেলুন। যার সামনের বড় সাইনবোর্ডে লেখা, ‘এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি চুল কাটা হয়’।
যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা বিনা খরচে এই সেলুন থেকে চুল দাড়ি কাটাতে পারেন। এমনকি এই সেবার জন্য সেলুনের অন্য কোন নামও রাখেননি গোপাল চন্দ্র। দেশপ্রেম, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা আর গভীর মমত্ববোধ থেকেই প্রায় ২৬ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধাদের এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার মতে, ক্ষুদ্র পরিসর থেকে এটা তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা।
গোপাল চন্দ্র শীল বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধের কয়েকবছর পর জন্ম আমার। কিন্তু জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কল্যাণেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। আমার ক্ষুদ্র আয় থেকে হয়তো অনেক বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না। সেজন্য তাদের নিয়মিত প্রয়োজনের অংশ চুল-দাঁড়ি কাটার বিনিময়ে আমি পারিশ্রমিক নিই না।’
শুধু যে ফ্রি চুল কাটেন এমনটা না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি দোকানে রেখেছেন বিশেষ ব্যবস্থা। কোনো মুক্তিযোদ্ধার এই দোকানে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। সবার আগে তাদের কাজ করে দেন তিনি। এমনকি চলাচলে অক্ষম কেউ থাকলে তাদের বাসায় গিয়েও ফ্রিতে চুল কেটে দেন গোপাল চন্দ্র।
এছাড়াও জাতির সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেখেছেন আলাদা কাপড়। যা বানানো হয়েছে লাল সবুজ পতাকার আদলে। গোপাল চন্দ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে পতাকা মুড়িয়ে গার্ড অব অর্নার দেওয়া হয়। কিন্তু আমি তারা জীবিত থাকতেই তাদের সেই সম্মানটা দিতে চাই। সেজন্যই পতাকার আদলে তাদের জন্য বিশেষ কাপড়ের ব্যবস্থা রেখেছি।’
গোপাল চন্দ্রের দেশপ্রেমের আরও প্রকাশ মেলে তার দোকানে ঢুকলেই। ছিমছাম দোকানের পুরোটা সাজিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ আর দেশের ইতিহাসকে ঘিরে। দেয়ালে সাটানো আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ছবি দিয়ে। যেন এক ছোট্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
গোপালের এই সেলুনে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা চুল-দাঁড়ি কাঁটিয়েছেন। নিতে না চাইলেও গোপাল চন্দ্রকে অনেকে জোর করে পারিশ্রমিক দিয়ে যান। অনেকে আবার এই দারুণ উদ্যোগ নিয়ে ডায়েরিতে লিখে যান শুভেচ্ছা বার্তা। কেউ লিখে যান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। আর সেসব সযতনে আগলে রাখেন গোপাল চন্দ্র শীল।
এমন এক বার্তায় মো. আব্দুল মতি তালুকদার নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা লিখে গেছেন ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা মো. মতিন তালুকদার অদ্য ২০ নভেম্বর ২০২২ জনাব গোপাল চন্দ্র শীলের সেলুনে ক্ষৌরকার্য সম্পাদন করতে এসে তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ঐকান্তিকতা ও ভালোবাসা দেখে মোহিত হলাম। গোপাল চন্দ্র মুক্তিযোদ্ধ দেখেনি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ভালোবাসা প্রমাণ করে তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।’
২০১৮ সালে হাজী মো. আফজাল নামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা লেখেন, ‘...সকালবেলা পায়চারি করতে করতে আমি গোপাল চন্দ্র শীলের সেলুনে এসে বসি এবং গোপালের সাথে অনেক দেশ প্রেমিক নিয়া আলোচনা হয়। তার দেশ প্রেমিক দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়া যাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তার গোটা পরিবারের জন্য দোয়া করি। মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, তার পরিবারের সকলের প্রতি মঙ্গল বয়ে আনুক।’
এমন উদ্যোগে স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছেও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পান গোপাল চন্দ্র। রফিক চৌধুরী নামের এক স্থানীয় বলেন, “নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। সে বহুদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার জন্য আমরা মহল্লাবাসীও গর্ববোধ করি।”
আবু জাফর নামের এক তরুণ বলেন, “গোপাল দা'র এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করে আমাদের স্বাধীন একটি দেশ উপহার দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমরা সবাই ঋণী। আমাদের উচিত, তার উদ্যোগের মত করে নিজ নিজ জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কিছু হলেও করা।”
গোপাল চন্দ্র এলাকার মানুষদের সাধুবাদ পেলেও মাঝে মাঝে কটু কথাও শুনেছেন। তবে এ নিয়ে তিনি বিরক্ত নন। তার ভাষায়, “দু'য়েকবার আমার এই উদ্যোগ নিয়ে এক দুইজন আমাকে প্রশ্ন করেছে। কিসের আশায় আমি এমন সেবা দিচ্ছি। মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে। তবে আমি বিনয়ের সাথেই তাদের বলেছি, আমি কোন কিছুর আশা থেকে এই উদ্যোগ নিইনি।”
“অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা কষ্টে দিন পার করেন। তাদের জন্যই আমি ক্ষুদ্র জায়গা থেকে এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। অনেকে আবার সচ্ছল। তবে আমার এখানে সব মুক্তিযোদ্ধা সমান। আমি কারো কাছ থেকেই পয়সা নিই না। কিন্তু কেউ কেউ জোর করে দিয়ে যান। অনেক চাইলেও তাদের আটকাতে পারিনা,” তিনি যোগ করেন।
দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি চুল কাটার সেবা দিয়ে আসা গোপালের ইচ্ছা, বাকী জীবনেও এই সেবা চালু রাখার। গোপাল চন্দ্র বলেন, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার দোকান যতদিন থাকবে, ততদিন এই সেবা দিয়ে যাব। আমার পরিবারের সদস্যদেরও বলেছি, আমার অবর্তমানেও যদি কেউ এই দোকান চালু রাখে তারা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের এই সেবাটি দিয়ে যায়।’
ফরহাদুর রহমান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।