যেভাবে বাংলায় এলো সিঙ্গাড়া


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: January 27, 2023 16:30:17 | Updated: January 28, 2023 16:28:17


সিঙ্গাড়া তৈরি করা হয় সমভুজ আকৃতিতে। ছবি: পেটপূজাবাঙ্গালি.ইন

বিকেলের নাস্তায়, ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা চায়ের কাপে- সবখানেই বিশেষ কদর রয়েছে সিঙ্গাড়ার, আছে নানান রকমফের। আলু, কলিজা, পেঁয়াজসহ আরো বহু কিছু দিয়েই হয় সিঙ্গাড়া।

তবে এই সিঙ্গাড়া কিন্তু শুরুতে বাংলা অঞ্চলে ছিলোই না। শুধু বাংলা নয়, সমগ্র উপমহাদেশেই ছিলো না। মোগল আমলে পারস্য বা ইরান থেকে প্রচুর মোগলাই খাবার বাংলায় আসে। তার সঙ্গেই আসে ভেতরে মাংসের পুর দেয়া ত্রিকোণ আকৃতির একটি খাবার, যার নাম 'সাম্বোসা।' ইতিহাসবিদ আবুল ফজল এর 'তারিখ-ই-বেহাগি' বইয়ে উল্লেখ আছে 'সাম্বোসা'-র কথা। এই খাবারটিই আরো অনেক পরে বাংলায় প্রচলিত হয় সামোসা / সমুচা নামে। তবে সিঙ্গাড়া বাংলায় প্রচলিত হয় আরো অনেক পরে।

সময়টা ১৭৬৬ সাল। কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে আসীন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তার রাজসভায় লুচি-হালুয়া তৈরির কাজ করতেন হালুইকর গিরীধারী। তার পিতা গুণীনাথ হালুইকর এসেছিলেন কলিঙ্গ (বর্তমানে ওড়িষ্যা) থেকে। গুণীনাথের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী চমৎকার হালুয়া ও লুচি বানাতেন।

সে সময় কৃষ্ণচন্দ্র আক্রান্ত হন মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগে। একেবারেই দুরারোগ্য রোগ। সমস্ত মিষ্টি নিষেধ। হালুয়া নিষিদ্ধ হওয়ায় লুচিও না খেয়ে ফেরত পাঠানো হতে থাকলো রাজদরবার থেকে। গিরীধারী ভাবলেন হয়তো তার বানানো হালুয়া মহারাজার মনঃপূত হচ্ছে না। তাই অনুমতি চাইলেন নতুন কিছু মিষ্টান্ন তৈরি করে রাজা মশাইয়ের কাছে পাঠানোর।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। গিরীধারী হালুইকরকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। তারপর অনুনয়-বিনয় করে হালুইকর প্রাণে বাঁচেন। সভাসদরা রাজাকে পরামর্শ দিলেন, রাজার জন্য মিষ্টান্ন বিষের তুল্য, আর হালুইকর রাজাকে মিষ্টিই খাওয়াতে চান! কী স্পর্ধা! রাজাকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চান তিনি।

রাজা নির্দেশ দিলেন তিনরাতের ভেতর হালুইকরকে সপরিবার দেশ ছাড়তে হবে।

দ্বিতীয় রাতে, হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী ঠিক করলেন তিনি দেখা করবেন রাজার সাথে। পরদিন সকালে দেখা হলো। রাজা জানতে চাইলেন দেখা করতে চাওয়ার কারণ। ধরিত্রী দেবী জানালেন, তিনি এমন একটি খাবার তৈরি করতে পারবেন যা কিছুক্ষণ বাদে বাদে খাওয়া সম্ভব। এছাড়া, এটি সহজে ঠান্ডাও হবেনা।

ধরিত্রী দেবী গেলেন রন্ধনশালায়। রাজ পাচক ততক্ষণে আলুর তরকারি তৈরি করে অপেক্ষা করছেন চিন্তিত ভাবেই। আদেশ পেলেই লুচি ভাজতে হবে। হাতের সামনেই বিপুল পরিমাণ ময়দার তাল রাখা। হালুইকরের স্ত্রী এলেন। বসলেন ময়দার তাল নিয়ে। লুচি বেলে, কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির সাথে খাওয়ার জন্য তরকারি ভরে দিয়ে, সমবাহু ত্রিভুজের মতো গড়ন বানিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

রাজাজ্ঞা এলো। তরকারি ভর্তি ত্রিভুজাকৃতির এমন দশটি লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়াইয়ে ফেলেই নেড়েচেড়ে তুলে নিলেন ধরিত্রী দেবী। তারপর সোনার থালায় সোনালি রঙের সেই ত্রিভুজগুলো সাজিয়ে নিয়ে চললেন রাজামশাইয়ের দরবারে।

রাজা খাবারটি দেখে খুব অবাক হলেন৷ হালুইকরের স্ত্রী জানালেন, এর নাম 'সমভুজা।' এখন খুবই গরম আছে। পুরোটা একবারে মুখে নিলে জিভ পুড়তে পারে। তাই আগে যেন রাজামশাই এক কামড় দিয়ে দেখেন গরম কেমন, সাথে স্বাদটাও জানান।

খাবারের স্বাদ নিয়ে বিস্মিত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তিন ছড়া মুক্তার মালা খুলে দিয়েছিলেন ধরিত্রী দেবীর হাতে। প্রত্যাহার করেছিলেন নির্বাসনের আদেশ৷ এরপর প্রায় প্রতিদিনই তার পাতে থাকতো সমভুজা।

কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রতি সন্ধ্যায় একথালা সমভুজা নিয়ে বসতেন৷ তার লেখা থেকে জানা যায়, দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি হাতি ভেট নিয়ে গিয়েছিলো উমিচাঁদের কাছে- বাইশটি সোনার থালা ভর্তি সমভুজা। প্রতি থালায় ছিলো একশটি করে।

তবে এই সিঙাড়ার জন্য মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সারা ভারতজুড়ে স্বীকৃতি পেলেও এর পুরো কৃতিত্বই গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবীর।

এখানে উল্লেখ্য, পারস্যে সাম্বোসা বলে যে খাবারটি ছিলো, তা ছিলো মূলত যব ও ময়দার তালের সাথে গাজর, কড়ইশুঁটি, রসুন ও মাংস ম্যারিনেট করে সেঁকে খাওয়া। পারস্য থেকে ভারতবর্ষ এসেও তারা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকে খেতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে তারা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে দেখতে পান ময়দার ভেতর পুর হিসেবে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মশলা দিয়ে তৈরি আলুর তরকারি। এই খাবারটি অঞ্চলভেদে পরিচিতি পায় সিঙাড়া/ সাম্বোসা নামে।

কিন্তু কী করে হলো এই নামের বিবর্তন? মূলত সমভুজা থেকে এর নাম হয়েছিলো সম্ভোজা।

তারপর, সম্ভোজা> সাম্ভোসা>সামোসা।

এখান থেকে মূলত সামোচা/সমুচা  নামটি আসে। তবে সেটি মূলত মাংসের পুর দেয়া খাবারের ক্ষেত্রেই প্রচলিত ছিলো।

কিন্তু ধরিত্রী দেবীর বানানো সেই আলুর পুর দেয়া সমভুজা? সেটি সিঙ্গাড়া হয়ে বাংলায় রয়ে গেছে মূলত নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে।

বিবর্তনটি এমন, সমভুজা> সম্ভোজা> সিভুসা> সিঙুরা (নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে) > সিঙ্গাড়া।

সেই থেকে আজও শেষ সকাল কিংবা বিকেলের নাস্তায়, চায়ের কাপে আড্ডায় সঙ্গী সিঙ্গাড়া।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like