যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই নিউ ইয়র্কে এক নাগরিক সংবর্ধনায় বক্তৃতা করলেন বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, প্রথমবারের মত কথা বললেন ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগে র্যাব ও তার ওপর আরোপিত মার্কিন কড়াকড়ি নিয়ে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
ওই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, “তারা অভিযোগ করেছেন যে, ২০০৯ সাল থেকে নাকি র্যাব কর্তৃক ৬০০ লোক গুম হয়েছেন। অথচ আমি র্যাবে ঢুকেছিলাম ২০১৫ সালে। তাহলে আমাকে কেন ওই তালিকায় নেওয়া হয়েছে?”
বৃহস্পতিবার জ্যাকসন হাইটসের কাছে গুলশান টেরেস মিলনায়তনে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, “আমি মার্কিন প্রশাসন অথবা আমেরিকানদের দোষারোপ করতে চাই না। কারণ, এটা করেছে তারাই, যারা সত্তর সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দেয়নি, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল।
“ওই গোষ্ঠী বার্ষিক ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চারটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল। সেই ভাড়াটে ফার্ম টানা তিন বছর চেষ্টা করেছে কথিত স্যাংশনের জন্যে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব, এর সাবেক প্রধান, বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সে সময় বলা হচ্ছিল, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়েই জাতিসংঘের পুলিশ প্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন তিনি।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ৩১ অগাস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ প্রধানদের এই সম্মেলন হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল তাতে অংশ নেয়।
আইজিপি বেনজীর আহমেদ ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মু আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ উপমহাপরিদর্শক নাসিয়ান ওয়াজেদ ও সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিলেন এ প্রতিনিধি দলে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত ওই নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন আইজিপি। ‘যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক কমিটি’র ব্যানারে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা হিন্দাল কাদির বাপ্পা। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল মুনিরুল ইসলামও ছিলেন মঞ্চে।
গতবছর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় যুক্তরষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে র্যাবের মাধ্যমে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ’ রয়েছে, যা আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ‘খাটো করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলেছে’।
সেখানে বলা হয়, “বেসরকারি সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে ছয় শতাধিক গুম এবং ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ছয়শ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য দায়ী।”
বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়াই’ যুক্তরাষ্ট্র ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
পাঁচ বছর র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ পুলিশের নেতৃত্বে আসা বেনজীর আহমেদ নিষেধাজ্ঞার পর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে সরাসরি এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে নিউ ইয়র্কের সংবর্ধনায় তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।
আইজিপি বলেন, “বড় সত্য হচ্ছে ২০০৯ সালে আমি এই নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে চাকরিতে ছিলাম। প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে ৬০০ লোক গুমের অভিযোগ করা হয়েছে তাদের কোনো তালিকা কোথাও প্রকাশ করা হয়নি।”
তথ্য সন্ত্রাস
বাংলাদেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে যে অভিযোগ ক্ষমতাসীনরা করে আসছেন, একই ধরনের অভিযোগ আইজিপিও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে করেন।
তিনি বলেন, “২২ জন তথ্য সন্ত্রাসী রয়েছে। এদেরকে জবাব দিতে হবে। আপনি যে মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেই বিশ্বাসে যদি চ্যাম্পিয়ন হোন, তাহলে আপনাকেই সেটি পালন করতে হবে।”
অপপ্রচারের ক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়াকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে কথা তুলে ধরে বেনজীর আহমেদ বলেন, “এক সময় মনে করা হয়েছিল যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাংবাদিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি আমরা?
“আশা করা হয়েছিল সমাজের তথ্যচিত্রটি সবিস্তারে উঠে আসবে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে যত ভুয়া, আজগুবি তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। তথ্য সন্ত্রাসীরা দেশের বিরুদ্ধে, মানবতাবিরোধী যতসব অপপ্রচারণা চালাচ্ছে।”
তার ভাষায়, “নোংরা জিনিস ফেইসবুকে দেখামাত্র ফ্লাশ করা দরকার। এবং এর বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্যকে উপস্থাপন করতে হবে, তাহলেই মিথ্যার পরাজয় ঘটবে।”
সংবর্ধিত আইজিপি বলেন, “বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, এমন সময়ে কখনো কখনো কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়। দেশের প্রয়োজনে, নাগরিকদের স্বার্থে, মানবিকতার প্রশ্নে কখনো কখনো জেনারেশনকে দায়িত্ব নিতে হয়।
“স্বাধীনতার সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছি। এখন চলছে মুক্তির লড়াই। এ লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এই লড়াইয়ের জিততেই হবে।”
বাঙালির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেনজীর আহমেদ বলেন, “বঞ্চনা, জুলুম-নির্যাতন, শোষণের কবলে ছিলেন বাঙালিরা। কখনো শাসন ক্ষমতা পাননি। অথচ এই সময়ের মধ্যে চার বাঙালি নবেল পুরস্কার জয়ী হয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব পাননি।
“বঙ্গবন্ধু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এবং তার কন্যা শেখ হাসিনাও একই চেতনায় বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে এনেছেন। তার বিচক্ষণতাপূর্ণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে।”
প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করার এই চলমান লড়াইয়ে তিনিও ‘সকলের সঙ্গে’ রয়েছেন।
“দেশের বিরুদ্ধে, উন্নয়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তাকে রুখে দিতে হবে।… এর আগে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে প্রতিবারই বাঙালি জয়ী হয়েছে “