Loading...
The Financial Express

ভয়ের শূন্য রেখা থেকে পালিয়ে অনিশ্চিত জীবনে

| Updated: January 24, 2023 15:00:42


বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলি-সংঘাতের সময় আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর শূন্য রেখায় বসবাস করা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ পালিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে আশ্রয় নিয়েছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় গত পাঁচ দিন ধরে হাজারো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে টাঙানো পলিথিনের তাঁবুতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। পর্যাপ্ত খাদ্য, পানীয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই সেখানে।

এই রোহিঙ্গারা ‘পোড়া মাটিতে’ ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। তারা বলছে, যে কোনো সময় আবারও সংঘাতে জড়াতে পারে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দুই গোষ্ঠী আরসা ও আরএসও।

আন্তর্জাতিক সংস্থার ত্রাণ সাহায্যের উপর সম্পন্ন নির্ভরশীল এই মানুষগুলো জানে না, ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, আগামী দিনে তাদের খাদ্যের সংস্থানই বা কোথায় থেকে আসবে।

নতুন আসা এই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসনও কিছু বলতে পারছে না। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

রোহিঙ্গারা জানান, আগের কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় গত বুধবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কোনারপাড়া শূন্যরেখা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় একজন নিহত এবং এক শিশুসহ দুই রোহিঙ্গা আহত হন।

সংঘাতের জের ধরে ওইদিন বিকালে শূন্য রেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে ক্যাম্পের প্রায় সবকয়টি ঘর পুড়ে যায় বলে রোহিঙ্গাদের ভাষ্য। সেখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করতেন।

অগ্নি-সংযোগের পর ক্যাম্প লাগোয়া সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের একটি অংশ আত্মরক্ষার্থে মিয়ানমার ভূখণ্ডে চলে যায়। অপর একটি অংশ নিকটবর্তী তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, তুমব্রু বাজার, আশপাশের পতিত জমিতে আশ্রয় নেয়।

শূন্যরেখায় অবস্থান করা এসব রোহিঙ্গাদের অবস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ১৩ লাখ রোহিঙ্গাদের চেয়ে ভিন্ন। মূল ভূখণ্ডে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা তালিকাভুক্ত। তাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি)। বাইরে কাজের অধিকার না থাকা এসব রোহিঙ্গার জীবন চলে বাংলাদেশ সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণের উপর নির্ভর করে।

কিন্তু শূন্য রেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন বা বেসরকারি সংস্থা কিছু করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদেরকে শুধু আন্তর্জাতিক রেডক্রস-রেডক্রিসেন্ট কমিটির (আইসিআরসি) ত্রাণের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। এখন শূন্য রেখা থেকে বিতাড়িত হওয়ায় তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তুমব্রুতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন সেখানে পলিথিন, বাঁশ ও ত্রিপলসহ অস্থায়ী উপকরণ দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে অবস্থান করছে। এতে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষদের যেমন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও এলাকা ছেড়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মী ও জনপ্রতিনিধি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলম বলেন, “গত বুধ ও শুক্রবার যেসব রোহিঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিদ্যালয় মাঠ ও আশপাশের পতিত জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলো তারা এখনও সেখানেই অবস্থান করছে। তারা আগুনে পুড়ে যাওয়া শূন্যরেখার ক্যাম্পে যেতে চাচ্ছে না। তারা মানবেতর দিনযাপন করছে।”

ইউপি সদস্যের ধারণা, তুমব্রুতে এখন দুই সহস্রাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। শনিবার কয়েকটি এনজিও কিছু পলিথিন ও ত্রিপল দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে তাবু তৈরি করে তারা সেখান অবস্থান করছে। তাদের অবস্থানস্থলের আশপাশে স্থানীয়দের চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, “শূন্যরেখার ক্যাম্পের অধিকাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের তুমব্রুতে চলে এসেছে। তারা সেখানে চার দিন ধরে অবস্থান করছে। বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।”

তবে এখনও প্রশাসনের কোনো নির্দেশ পাননি জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত দেবে ইউনিয়ন পরিষদ সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।”

তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে আশ্রয় নেওয়া নুরুল আলম (৫০) নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, বুধবার ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা প্রথমে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে মিয়ানমার ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে একদিন অবস্থানের পর শুক্রবার মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি জোর করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ভুক্তভোগী এ রোহিঙ্গা বলেন, “তাই আমরা এখানে (তুমব্রু) আশ্রয় নিয়েছি। জানি না, আমাদের ভাগ্যে কী আছে। এখানে ঘর নেই, পানি নেই, টয়লেট নেই, খাবার নেই। এখন পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে টাঙানো তাঁবুতে আছি।”

তুমব্রুতে আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা আব্দুল হামিদ (৩৯) বলেন, “মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর আগের দুর্দশায় পড়েছে এতদিন ধরে শূন্য রেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গারা। এখন ঠিকানাবিহীন দুঃশ্চিন্তায় কাটছে তাদের জীবন। বিবাদমান সশস্ত্র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের জেরে শূন্যরেখায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ক্যাম্পে ফিরে যেতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছে।”

তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, “শূন্যরেখার ক্যাম্পে থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গারা তুমব্রু বাজার ও স্কুলের আশপাশে খালি জায়গায় বাঁশ-কাঠ ও ত্রিপল দিয়ে তাঁবু তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়রা ধারণা করছেন, এটিও নতুন করে একটি ‘রোহিঙ্গা পল্লি’ হতে যাচ্ছে।”

তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর রহিম বলেন, “বুধবার সীমান্তে সশস্ত্র দুই পক্ষের সংঘাতের জেরে বেশকিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা স্কুলসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এতে ওইদিন থেকে স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। তবে রোববার থেকে স্কুলের প্রশাসনিক কার্যক্রম চললেও সোমবার বা পরদিন থেকে পাঠদান শুরু হবে।“

এসব রোহিঙ্গার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুজ্জামান চৌধুরী বিকালে বলেন, “উদ্ভূদ পরিস্থিতিতে শূন্যরেখার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক রেডক্রস-রেডক্রিসেন্ট কমিটি (আইসিআরসি) এর মাধ্যমে শনিবার হতে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।“

তাদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বক্তব্য জানতে বুধবার বিকালে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াসমীন পারভীন তিবরিজিকে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন ধরনেনি।

পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুরাইয়া আক্তার সুইটিকে কল করা হলে তিনি ফোন ধরেন।

কতজন রোহিঙ্গা তুমব্রুতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের দেখভাল কারা করবেন, তারা এখন কোথায় আশ্রয় নেবেন- এসব বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসকই জেলার মুখপাত্র। যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে, আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলতে পারব না। আর আইন-শৃঙ্খলার বিষয়ে বলতে পারবেন অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেট।”

পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) উম্মে কুলসুমকে কল করা হলে তিনি এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এডিএম উম্মে কুলসুম বলেন, “আপনারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে তথ্য নেন। উনি আপনাদের তথ্য দিতে পারবেন।”

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, “কৌশলগত কারণে সব কথা বলা যাচ্ছে না। এতটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সীমান্ত পরিস্থিতি কঠোর নজরদারি করছে। শূন্য রেখার ক্যাম্পে থেকে বের হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীবিড় ও কড়া নজরদারিতে রেখেছে। শূন্যরেখার ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে এখন কত রোহিঙ্গা এসেছে তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।”

তবে তুমব্রুতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এখনও কোনো ধরনের নির্দেশনা পাননি বলে জানান ইউএনও।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসারাসহ অনন্ত ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয় কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্পে।

ওইসব ক্যাম্পের সার্বিক দেখভাল ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি)। অপরদিকে তুমব্রু কোনারপাড়া শূণ্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পটির দায়িত্ব পালন করছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট কমিটি (আইসিআরসি)। ক্যাম্পটিতে ৬৩০টি পরিবারে সাড়ে চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করে আসছিল।

Share if you like

Filter By Topic