প্রিকারিয়েত: শ্রেণিবিদ্বেষের নতুন শাখা


ফাইয়াজ আহনাফ সামিন | Published: January 28, 2023 16:36:54 | Updated: January 29, 2023 17:49:09


প্রিকারিয়েত: শ্রেণিবিদ্বেষের নতুন শাখা

বর্তমান বিশ্বে যত সম্পদ আছে, তার সিংহভাগ রয়েছে মাত্র ১ ভাগ মানুষের হাতে। বাকি যতটুকু সম্পদ, তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির হাতে। এই বিভিন্ন শ্রেণির আবার নানা ভাগ দেখা যায়। উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শ্রমিক শ্রেণি, ইত্যাদি। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স শ্রমিক শ্রেণির নাম দিয়েছিলেন প্রলেতারিয়েত। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় সর্বহারা শ্রেণি। এরা সমাজের বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত শ্রম বিক্রেতা শ্রেণি। বঞ্চিত ও শোষিত এই সর্বহারা শ্রেণিকে কার্ল মার্ক্স যে অর্থে সর্বহারা বলেছিলেন, যদি আমরা বর্তমান অবস্থার সাথে তার তুলনা করি তবে আদতে তারা সর্বাংশে তা ছিল না।

তাদের জীবনের নিরাপত্তা ছিল। নিরাপত্তা বলতে অন্তত চাকরির নিশ্চয়তা ছিল। যে কুলির কাজ করতো, সে আজীবন কুলির কাজই করে যাওয়ার সুযোগ পেত। কিংবা যে ছিল মুটে,মজুর বা কারখানার শ্রমিক - তার ছিল একটি নির্দিষ্ট কর্মস্থল। এছাড়াও তারা বিভিন্ন ইউনিয়ন করে নিজেদের দাবির জন্য প্রতিবাদ করতে পারতো। হরতাল-আন্দোলন করে বা যেভাবেই হোক, কাজ করা বন্ধ করে নিজেদের দাবি আদায় করার ন্যুনতম সুযোগ ছিল প্রলেতারিয়েতদের।

কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে আমরা শ্রেণির প্রকারভেদে নতুন এক শাখার জন্ম দেখতে পাচ্ছি। এর নাম প্রিকারিয়েত। প্রিকারিয়েত শব্দটি এসেছে প্রিকারিয়েস থেকে। এর অর্থ হলো অনিশ্চিত। সহজ ভাষায় প্রিকারিয়েতের সংজ্ঞায়ন করতে হলে বলা যায়, যে শ্রেণির মানুষেরা চাকরিজীবি বা শ্রমজীবি হওয়া সত্ত্বেও জীবনের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় ভুগে তারাই প্রিকারিয়েত।

কারা আছে এই প্রিকারিয়েত শ্রেণিতে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় হলো সাধারণ যুব-জনতা। যাদের যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও তারা সে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পায় না। শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীর সংখ্যা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে সমাজে প্রিকারিয়েতদের সংখ্যা।

গত ৫০ বছরে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির যে প্রসার বিশ্বব্যাপী হয়েছে, এর ফলে পুঁজিবাদ প্রতিনিয়ত গ্রাস করে নিয়েছে চাকরির বাজার। এছাড়াও বদলেছে বাণিজ্যের ধরণ। শ্রমের বিপরীতে শ্রমিকের বাহুল্যতার কারণে দিন দিন সস্তা হচ্ছে চাকরির বাজার। চাকরিপ্রার্থী নয়, চাকরিদাতা তথা উৎপাদন গোষ্ঠীর কাছে। শ্রমবাজারে স্বল্পমূল্যেই যদি উৎপাদকরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শিক্ষিত কর্মী পায়, তবে অবশ্যই তারা তাদেরকে লুফে নিবে। যার ফলে আবার বঞ্চিত হয় যোগ্য কর্মীরা।

এই নব্য পুঁজিবাদের অর্থনীতিতে কোটি কোটি মানুষ তাদের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট তথা Stable কাজে আটকে রাখতে পারছে না। চাকরি ও কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা যেন সরকারি চাকরি ছাড়া কোথাও নেই। এই অস্থিতীশীলতার জীবন তাদের দেয় শুধুই হতাশা আর দুর্গতি।

এই প্রিকারিয়েত শ্রেণীর যুবারা বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও বিপজ্জনক। সমাজের ক্রমাগত বঞ্চনা আর অবহেলা পেতে পেতে তাদের মনে জমে ওঠে ক্রোধের বাষ্প। জমতে জমতে একদিন বাষ্প থেকেই হয় বিস্ফোরণ। যে সরকার তাদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধেই তারা উগরে দেয় ক্রোধের উদগীরণ। নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা ফেসবুক-টুইটার ইত্যাদি ব্যবহার করে তারা দ্রুতই শিখে নেয় কিভাবে গণ জমায়েত করে গড়ে তুলতে হয় গণবিদ্রোহ।

সমাজে কোনো অবিচার বা অন্যায্যতা দেখলেই প্রিকারিয়েতরা আন্দোলনে নামে। এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আমরা দেখি বিশ্বব্যাপী। প্রিকারিয়েতরাই করে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন। তাহরির স্কয়ার থেকে তাকসিম স্কয়ার- সবখানেই তারা গড়ে তোলে অবরোধ। আমাদের বাংলাদেশেও আমরা প্রিকারিয়েতদের বিভিন্ন আন্দোলন দেখতে পাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন- প্রিকারিয়েতরা আওয়াজ তোলে সবখানে। এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও যে শিক্ষিত ও বঞ্চিত যুবসমাজ যুদ্ধে নেমেছিল- তাদেরকেও ফেলা যায় প্রিকারিয়েতের সংজ্ঞায়।

প্রিকারিয়েতরা শিক্ষিত হয় ভালো জীবনের আশায়। কিন্তু যখন দেখে তাদের থেকে কম যোগ্য কেউ দূর্নীতি করে তাদের চেয়েও বেশি এগিয়ে যায়, তখনই তারা ডুবে যায় হতাশা আর ক্ষোভে। যে দেশে যত বেশি দূর্নীতি সে দেশে তত বেশি প্রিকারিয়েত। এদেরকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী নাম দিয়েছেন শহুরে শিক্ষিত নিম্নবর্গ।

জীবনের প্রতি অসহ্যকর অসন্তোষ নিয়ে, গলায় ডিগ্রীর সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে এ শ্রেণির যুবারা দুর্নীতিবাজদের গড়ে তোলা চাকরিবাজারে ধরনা দিতে দিতে জীবন পার করে ফেলেও পায় না যথাযথ সম্মান। তাদের দাবিয়ে রাখা হয় সর্বত্র উন্নয়নের মরীচিকা দেখিয়ে।

বাংলাদেশে প্রিকারিয়েত নিয়ে খুব একটা গবেষণা করা হয়নি। কিন্তু যারা নিজেদের জীবনকে প্রিকারিয়েতের সকল সংজ্ঞা কিংবা উদাহরণের সাথে মিলাতে পারবেন বা অনুভব করবেন যে তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অবিচার হয়েছে- তারা সবাই-ই প্রিকারিয়েত।

 

ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

faiyazahnaf678@gmail.com

Share if you like