প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো কবিতা প্রদর্শনী


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: September 27, 2022 15:33:37 | Updated: September 27, 2022 20:41:30


ছবি: লেট এক্সপ্রেশন বি ফ্রি

ছবি প্রদর্শনীর কথা শোনা যায় অহরহ। দেখতেও যান অনেকেই। কিন্তু ছবির মত করে যদি হয় কবিতার প্রদর্শনী! দেয়ালে টানানো ফ্রেমে বইয়ের পাতার মত ছাপা অক্ষরে সচিত্র কবিতা! বাংলাদেশে প্রথমবারের মত তরুণ ১৫ জন কবি ও তাদের ৩২ টি কবিতা নিয়ে এমন মনোমুগ্ধকর আয়োজন হয়ে গেলো এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ঢাকার লালবাগের চালচিত্র ক্যাফেতে।

গত ১৫, ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর লালবাগের চালচিত্র ক্যাফেতে (৩ নং ঢাকেশ্বরী রোড, ছাতাওয়ালা মসজিদের সামনে, বাম দিকে) আয়োজিত হলো বাংলাদেশের প্রথম কবিতা প্রদর্শনী। ‘লেট এক্সপ্রেশন বি ফ্রি’ নামে একটি সংগঠন এর আয়োজন করে।

পাশাপাশি ১৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ আয়োজনের প্রথম দিনে তরুণদের ভাবনায় রাজনৈতিক কবিতা শীর্ষক একটি ইভেন্টে আলোচক হিসেবেও উপস্থিত  à¦¥à¦¾à¦•à¦¾à¦° কথা বলেন প্রোগ্রামটির কিউরেটর সৈকত আমীন।

এরপর আরো দুদিন (১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বরচলে এই আয়োজন। দ্বিতীয় দিনে প্যারোডি কবিতা বিষয়ে হয় আলোচনা। তৃতীয় দিনে ছিলো অন্য দুদিনের মতই কবিতা প্রদর্শনী ও কবিতা পাঠ।

প্রথম দিন আলোচনায় আরো ছিলেন কবি কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ ও কবি সজীব তুষার। সঞ্চালক অনুপম দেবাশীষ রায় প্রশ্ন করলেন স্বাধীনতা, কবিতা লেখার ধরন, কবিতায় গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রে কবিতা বিষয়ে।

এরপর দ্বিতীয় দিন আলোচক হিসেবে ছিলেন কবি সোয়েব মাহমুদ, জাহিদ জগত ও হিমেল হাসান বৈরাগী।  কোনো কবিতার প্যারোডি, বাকস্বাধীনতা, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণবাদিতা নিয়ে রসপূর্ণ, সাহসী ও ব্যঙ্গাত্মকতার সমন্বয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করলেন তারা।

আয়োজনের শেষ দিনে কথা হয়েছিলো আয়োজক অনুপম দেবাশীষ রায় এর সাথে। তিনি জানান,

“আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ‘লেট এক্সপ্রেশন বি ফ্রি’ আয়োজন করে তিনদিন ব্যাপী কবিতা প্রদর্শনীর, যার শিরোনাম 'নৈঃশব্দের শব্দেরা'। সাম্প্রতিক সময়ের তরুণ ও উদীয়মান ১৫ জন কবির ৩২ কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই আয়োজন।

“গণতন্ত্র, সুশাসন ও বাকস্বাধীনতার ওপর তাদের চিন্তাগুলোকে আমরা ফ্রেমবদ্ধ করছি, যার সাথে আছে নান্দনিক অলংকরণ। বাংলাদেশে এ ধরনের কবিতা প্রদর্শনী এবারই প্রথম।”

এই আয়োজনে থাকা কবিতাগুলোয় এ সময়ের না বলা কথাগুলোও তুলে এনেছেন কবিরা। বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে এ ধরনের কবিতা প্রদর্শনীর বিষয়ে প্রোগ্রামের কিউরেটর সৈকত আমীন বললেন, “কবিতা পাঠ হয়, আবৃত্তি হয়, কবিতা নিয়ে নানান আলাপ আলোচনা হয়। তবে কবিতার এক্সিবিশন ধারণা করি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক নতুন ঘটনা। কথা বলার জন্য নির্যাতন, কারাবরণ, এমনকি গুম হওয়ার ঘটনার কথাও জানা গেছে। চারিদিকে এমন নৈঃশব্দতার মধ্যেও যারা নিঃশব্দ নন, এমন ১৫ জন কবির কবিতা নিয়ে এই আয়োজন; যাদের কবিতায় এই নিঃশব্দতার বিপরীতে ধ্বনিত চিৎকার উঠে এসেছে।”

ছবি: লেট এক্সপ্রেশন বি ফ্রি

এই ১৫ জন কবির ভেতর ছিলেন – কালপুরুষ, খুরশিদ রাজীব, জাহিদ জগত, সৈকত আমীন, রহমান মুফিজ, সজীব তুষার, হিমেল হাসান বৈরাগী, সোয়েব মাহমুদ, কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ, আতিক আনন্দ কর, মাহমুদ নেওয়াজ জয়, দিদারুল ইসলাম, ইসরাত জাহান, দিপেন্দ্রনাথ দাশ ও অনুপম দেবাশীষ রায়।

চালচিত্র ক্যাফের এই আয়োজনে দর্শক সাড়া ছিলো মনোমুগ্ধকর। এই ক্যাফেটি তাদের কেক-পেস্ট্রি ও বেকারী আইটেমসমূহ ও নানা ধরণের কফির জন্য খ্যাত। দর্শকদেরও দেখা গেলো পছন্দমত বিভিন্ন আইটেম নিয়ে খেতে, গল্প করতে ও আলোচনা শুনতে।

কবিতার নামগুলো থেকেই ধারণা করে নেয়া যায় এদের বক্তব্যধর্মীতা বিষয়ে। সজীব তুষার যেমন হৃদয় মণ্ডল নিয়ে লিখেছেন, জাহিদ জগত পাটকল কবিতায় তুলে এনেছেন শ্রমিকদের দুর্দশা। কালপুরুষের 'একাত্তর' যেমন গভীর ভালোবাসা বুকে নিয়ে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ, অনুপম দেবশীষ রায়ের ‘মুজিব’ তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানকে কাল্ট ফিগারের বাইরে আমজনতার একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চাওয়ার প্রয়াস৷

রহমান মুফিজ তার মুখোমুখি-৫ এ গুমের জন্য রাষ্ট্র-সরকারকে তুলেছেন জবাবদিহিতার কাঠগড়ায়, সৈকত আমীন তৃতীয় বিশ্বের কবিতায় লিখেছেন কৃষকদের ভাতের জন্য সংগ্রাম ও মুক্তির কথা। সোয়েব মাহমুদ কোথাও বৃষ্টি নেইতে বলছেন গণমানুষের মুক্তি ও সুন্দর দিনের কথা। খুরশিদ রাজীবের রাষ্ট্রীয় ব্লটিংপেপারযেমন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা জানান দিয়েছে, তেমনি কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধের ‘জেনারেলকে লেখা চিঠি’-তে তিনি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণমানুষের সংহতির প্রতি আস্থা রেখেছেন৷

ছবি: লেট এক্সপ্রেশন বি ফ্রি

ক্যাফেতে আগত দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন ও পড়ছিলেন বিভিন্ন কবিতা। প্রতিটি কবিতার সাথে চমৎকার অলংকরণ করেছেন চিত্রশিল্পী, কবি ও বুনোফুল ব্যান্ডের গায়ক সাইনুর রহমান শুভ, যিনি সারশু নামেই বেশি পরিচিত। তিনি এ বিষয়ে বললেন, “ব্যক্তিগতভাবে যেসব কবিদের চিনি তাদের কবিতার ক্ষেত্রে ছবিতে সেই চেনাজানার প্রভাব রয়েছে৷ যাদেরকে চিনিনা তাদের ক্ষেত্রে শুধু কবিতার আলোকেই কাজ করেছি। কবিতার বক্তব্য আরো পরিষ্কার করাটা উদ্দেশ্য ছিল না এক্ষেত্রে। কবিতা পড়ে নিজের যে অনুভূতি তাকে ভিত্তি করেই আঁকা। বলা যায় একজন পাঠক হিসেবেই আমার সাব্জেক্টিভ ইন্টারপ্রেটেশন।”

“ছবি যেহেতু স্বভাবতই লেখার চেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এটা ছবি না, কবিতার প্রদর্শনী; সেক্ষেত্রে এইটুকু সতর্কতা রাখতে চেয়েছি যেন আঁকাগুলো কবিতার পানে দর্শককে নিতে সহায়কের ভূমিকাতেই শুধু থাকে , দর্শক আর কবিতার মাঝে যেন বাঁধা না হয়ে ওঠে। তবে কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছি যেন পুরোটা মিলে একটা অভিন্ন দেহ হয়, কবিতার সাথে ছবি বা ছবির সাথে কবিতা এমনটা যেন না মনে হয়। 

৩২টা কবিতা যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন কবির তাই সবগুলোর মাঝে জোর করে দৃশ্যগত মিল রাখতে চাইনি। বরঞ্চ  এক্ষেত্রে প্রতিটা কবিতাকে আলাদাভাবেই বিবেচনা করেছি।”

পাশাপাশি ছিলো পছন্দমত গান শোনার সুযোগ। চালচিত্রে প্রতিদিনই  বাজতে থাকে বিভিন্ন গান। এর ভেতর বব ডিলান,অঞ্জন দত্ত, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, কবীর সুমন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পপ গায়ক আলমগীরসহ বিভিন্ন শিল্পীর গানও শোনা গেছে।

 

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like