পারিবারিক জমিতে কৃষিকাজের দেখভাল করেন সিলেটের জকিগঞ্জের বারঠাকুরী ইউনিয়নের অমিত হাসান রাহিন; প্রায় ৩৫ বিঘা জমিতে এখন কেবল এক মৌসুমে আমন চাষ করেন তারা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান উৎপাদন তো দূরে থাক, পানির অভাবে শীতকালীন অন্যান্য ফসলও আবাদ করতে পারেন না রাহিনরা।
ওই এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে আগে যেটুকু ফসল উৎপাদন হত, তাও বন্ধ হয়ে যায় ২০১১ সাল থেকে; কারণ কুশিয়ারা নদী থেকে পানি নিতে পাম্প নির্মাণ প্রকল্পের জন্য রহিমপুর খালের মুখে দেওয়া হয়েছিল বাঁধ।
জকিগঞ্জের শরিফগঞ্জে ওই পাম্প নির্মাণ কাজ শেষ হলেও ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধায় বাঁধ অপসারণ করতে পারেনি বাংলাদেশ।
রহিমপুর খাল দিয়ে কুশিয়ারা নদীর পানি এনে জকিগঞ্জের ওই এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানি সরকারের পরিকল্পনা করেছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু রহিমপুর খালে পানির প্রবাহ না আসায় শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের সুযোগ আর হয়ে উঠছিল না সিলেটের কয়েক উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায়।
কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ায় রাহিনদের আশা, এবার তারা শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান উৎপাদন করতে পারবেন, ফলানো যাবে অন্যান্য ফসলও।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কেবল এক সিজনে আমন চাষ করতে পারতাম। পানির অভাবে অন্য দুই সিজনে কিছু করা সম্ভব হত না। পানি পেলে কমপক্ষে বোরো ধান চাষ করা যাবে। আর শীতকালীন শাকসবজিও উৎপাদন করতে পারব।”
এক নজরে
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত নদীর একটি কুশিয়ারা। এর পানির উৎস ভারতের বরাক নদী, যার উৎপত্তি ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পর্বতে। বরাক নদী কিছু দূর পর্যন্ত নাগাপাহাড় ও মণিপুর রাজ্যের মধ্যে সীমারেখা রচনা করেছে। এর পর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কাছাড় জেলার শিলচর থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অমলসিদ বরাক দুটি ধারায় ভাগ হয়ে যায়, একটি সুরমা নদী নামে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে কানাইঘাট হয়ে সিলেট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, অন্যটি কুশিয়ারা নামে দক্ষিণ দিকে এগিয়েছে। ১৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জ উপজেলাজুড়েই বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা নির্দেশ করে এগিয়েছে। অর্থাৎ নদীর এক পাড়ে বাংলাদেশ, অন্য পাড়ে ভারত। সুরমা ও কুশিয়ারা আবার ঘুরে ফিরে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলার মারকুলী এলাকায় এসে মিশে কালনী নাম নেয়, এরপর দক্ষিণ দিকে এগিয়ে ভৈরবে ধনুর সঙ্গে মিলে মেঘনা নাম ধারণ করে।
কুশিয়ারা নদীর পাড় থেকে ৩০০ মিটারের মধ্যে রহিমপুর খালের উপরে নির্মাণ করা হয়েছে শরিফগঞ্জ পাম্প হাউজ; সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে হাসিতলা গ্রামে রাহিনদের বাড়ি।
কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের জন্য চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ।
সফর শেষে ফিরে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এবারের সফরে গঙ্গার পর প্রথমবারের মতো অভিন্ন নদী কুশিয়ারা থেকে সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের আওতায় ১৫৩ কিউসেক পানি বণ্টনে আমরা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। এই সমঝোতা স্মারকের ফলে রহিমপুর সংযোগ খালের মাধ্যমে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে।”
কুশিয়ারা পাড়ের পাঁচটি উপজেলায় মোট ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা এখন পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
সিলেটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রধান মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারের সুবিধা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেচের সুযোগ তৈরি করা যে কোনো চুক্তি এই অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
“কারণ এখানে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের জন্য খাল বা নদীর পানিই প্রয়োজন। কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে বেশ আয়রন। আর পাথরের কারণে অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানি উঠানোও সম্ভব হয় না। পানি পেলে কৃষি উৎপাদনও বাড়বে।”
বাঁধ থেকে বাধা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুশিয়ারা থেকে পানি তুলতে বিভিন্ন খাল খনন ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া বেশ পুরোনো। ওই প্রকল্পের আওতায় রহিমপুর খাল খনন, রহিমপুর পাম্প হাউজ তৈরির প্রক্রিয়া ২০১০ সালে শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তারা বলছেন, এর আগে রহিমপুর খাল তেমন নাব্য না হলেও পানি কিছুটা আসত। খালে ধরে আসা পানি দিয়ে অল্পবিস্তর কৃষিকাজ চললেও খাল খনন ও পাম্প হাউজ নির্মাণকাজের সুবিধায় ২০১১ সালে রহিমপুর খালের মুখে একটি ক্রস বাঁধ নির্মাণের পর পানির আসার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগীয় অফিসের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্প’র অধীনে রহিমপুর খাল খনন, রহিমপুর পাম্প হাউজ তৈরি করা হয়েছে ২০১৬ সালে।”
পানির গতিমুখ বন্ধ করার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “রহিমপুর পাম্প হাউজটা তৈরি করার জন্য খালের মুখে একটা ক্রস ড্যাম দেওয়া হয়েছে, যাতে বন্যার পানি উঠে পাম্প হাউজ নির্মাণ কাজকে ডিস্টার্ব না করে আর কি।
“কিন্তু পাম্প হাউজ তৈরি করার পর যখন ক্রস বাঁধটা উঠানোর চেষ্টা হয়েছিল, তখন বিএসএফ বলে বসল, এটা নো-ম্যান্স ল্যান্ডের মধ্যে হইছে, এটা উঠানো যাবে না।”
চুক্তির মাধ্যমে পানি আনা সম্ভব হলে শুষ্ক ৫ হাজার হেক্টর জমির কৃষকরা উপকৃত হবেন জানিয়ে প্রকৌশলী শহিদুল বলেন, “এই চুক্তির ফলে আমরা কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি তুলতে পারব। যাতে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে চাষবাস করা হবে।
“কৃষকরা আগে কেবল আমন উৎপাদন করতেন, বোরোটা করতে পারত না। জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানিবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেন্সুগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় যাবে। খালে খালে পানি যাবে।”
কুশিয়ারা চুক্তি বাস্তবায়নের পর পানি পেলে শুষ্ক মৌসুমে নিজেদের ২০ বিঘা জমিতে বোরো ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনার কথা জানান জকিগঞ্জের বারঠাকুরিয়া ইফতেখার আহমেদ। শরীফগঞ্জ পাম্প হাউজ থেকে ২ কিলোমিটার দূরের অমলসিদ গ্রামে তাদের বাড়ি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১১ সালের আগে এখানে শুষ্ক মৌসুমে অল্পস্বল্প চাষাবাদ হলেও রহিমপুর খালের মুখে বাঁধ দেওয়ার পর তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। চুক্তির অনুযায়ী পানি পেলে শুষ্ক মৌসুমেও চাষাবাদ শুরু হবে।
“আমাদের জমিতে আমরা বোরো চাষ করব। এখানে আখ, তরমুজ ও আলু চাষাবাদ ভালো হয়। এছাড়া শীতকালীন শাকসবজির উৎপাদনও বেশ বাড়বে।”
পানি প্রত্যাহার দুই দেশেরই
১৫ বছরের জন্য সমঝোতা চুক্তির আওতায় সাত মাসের অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত এ পানি নেওয়া হবে জানিয়ে জেআরসির কারিগরি কমিটির সদস্য মালিক ফিদা এ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানে ড্রাই সিজনে কুশিয়ারা থেকে পানি নিয়ে একটা পাম্প হাউজের মাধ্যমে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করব।”
তিনি বলেন, “যে পানি উত্তোলন করছি, সেটা যে পরিমাণ পানি রয়েছে, তার তুলনায় তা খুব বেশি নয়; মাত্র ১০ থেকে ১৫% পানি। তার মানে আমরা ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করব কুশিয়ারা থেকে; তেমনিভাবে ভারত ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করবে।”
তিস্তা চুক্তি ১২ বছর ধরে ঝুলে থাকলেও কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিকে শেখ হাসিনার সফরের বড় সাফল্য হিসাবে দেখাচ্ছে দুদেশের সরকার।
তবে, নদী বিশেষজ্ঞ ড. খালেকুজ্জামান তেমনটা মনে করেন না।
তিনি ১৭ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শুকনো মৌসুমে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বাংলাদেশ অংশে গড়ে ৫,২৯৫ থেকে ১৭,৬৫০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়।
“সেই তুলনায় ১৫৩ কিউসেক পানি নিতান্তই সামান্য পরিমাণ (১ থেকে ৩ শতাংশ)। এই সামান্য পরিমাণ পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করার জন্য বাংলাদেশকে যদি ভারতের অনুমতি নিতে হয়, তা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।”
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেইনিয়ার লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক আরও বলেন, “এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অসংগতিপূর্ণ, কারণ কুশিয়ারার যে অংশের জন্য সমঝোতা হয়েছে, সেই অংশটি পুরোপুরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
“রহিমপুর খালের কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে কুশিয়ারা নদীর ভারতের অংশে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এ নোটি খালের গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে একটি জনপদ তৈরি করা হয়েছে, সেজন্য ভারতের বাংলাদেশের অনুমতি নেওয়ার দরকার হয়েছিল বলে জানা যায় না। এই নোটি খালটি বহমান থাকলে বরং শুকনো মৌসুমে কুশিয়ারায় পানিপ্রবাহ আরও বাড়ত।”
সেন্টার ফর এনভারনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ফিদা এ খান বলেন, “আমি মনে করি, বিগত ২৫ বছর পর আরেকটি মাইলফলক হয়েছে, যেখানে আমাদের দু’দেশের মধ্যে পানির সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আমরা গঙ্গা চুক্তি করেছিলাম। এরপর ২০২২-এ আমরা আরেকটি এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।”
আন্তঃনদী পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে অচলায়ন ভাঙার ক্ষেত্রে কুশিয়ারা চুক্তির তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকায় ভারতের বিদায়ী হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীও।
কুশিয়ারা নদীর চুক্তির বিষয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখানে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ রয়েছে যে ভারত পানি দেয় না। চুক্তি হওয়া একটি ভালো দিক, যার তাৎপর্য রয়েছে। নিঃসন্দেহে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় চুক্তির বিষয়টি ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত।”
নভেম্বরে বোরো মৌসুম শুরু হওয়ার আগে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রত্যাহার শুরু করার আশা প্রকাশ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা শহিদুল।
তিনি বলেন, “মাঠ পর্যায়ে বিএসএফ এখনো অবহিত হয়নি। আমরা যোগাযোগ করতেছি। মাঠ পর্যাযে বিএসএফ অবহিত হলেই হবে, এই জায়গায়।”