Loading...
The Financial Express

ইউনিভার্সাল মিউজিক: সঙ্গীতের মহাসমুদ্রে একদিন

| Updated: February 01, 2023 17:25:14


ইউনিভার্সাল মিউজিক: সঙ্গীতের মহাসমুদ্রে একদিন

মগবাজারের ওয়ারলেস রেলগেট থেকে একটু সামনে এগোলেই গ্রান্ড প্লাজা এখানে প্রবেশ করে সোজা কিছুদূর হাঁটলে চোখে পড়ে থরে থরে সাজানো সিডি আর ব্যানারে থাকা বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের ছবি৷ যার ভেতর আছেন হেমন্ত, মান্না দে, মোহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, শচীন দেব বর্মণ, রাহুল দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, নচিকেতা ঘোষ, আরতি মুখোপাধ্যায়, কে এল সায়গল- সহ আরো অনেকে। 

দোকানের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখা গেলো ভেতরে ডানপ্রান্তে বসে আছেন নীল পাঞ্জাবী পরিহিত মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক তার নাম সৈয়দ দানিক সঙ্গীতকে ভালোবেসে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্ত আছেন এই জগতের সঙ্গে 

শুরুটা হয়েছিল তার বড় ভাই সৈয়দ শামসুদ্দিন মানিকের হাত ধরে পেশায় তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী আর আর নেশা বা প্যাশন ছিল গান তিনি স্বাধীনতার পরে এলিফ্যান্ট রোডে প্রতিষ্ঠা করেন 'গানের ডালি'। সে সময় থেকেই বাংলাদেশে এইচএমভি, ইএমআই, আরপিজি, হিন্দুস্তান, সারেগামা, ভেনাস ইত্যাদি রেকর্ড লেবেলের আমদানিকারক পরিবেশক হয়ে ওঠেন তারা৷

তখন গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ ভারত, ইংল্যান্ড, জার্মানি থেকে নিয়মিত আসতো রেকর্ড বাংলা হিন্দি ক্লাসিকালআধুনিক গান থেকে ফিল্মের গান- সবকিছুই ছিল গানের ডালিতে 

নিয়মিত চাকরি সামলে প্রতিষ্ঠানটি চালানো সৈয়দ মানিকের জন্য কঠিন হয়ে যাওয়ায় তিনি তার ছোট ভাই সৈয়দ দানিককে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেন সেটা ১৯৮২ সালের কথা

উমা বসু ও সাবিত্রী ঘোষের সেই রেকর্ড দুটো। ছবি: লেখক

তারপর ৪০ বছর পেরিয়ে ৪১- পড়েছে সৈয়দ দানিক রয়ে গেছেন এর সঙ্গে তবে গানের ডালি দোকানটি এখন আর তেমন সচল নেই ২০০৯ সালে এক অগ্নি দুর্ঘটনায় দোকানটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়৷ তারপর সে বছরের জুনে ইউনিভার্সাল মিউজিক নাম নিয়ে সেটি স্থানান্তরিত হয় গ্রান্ড প্লাজায় 

বর্তমানে ক্যাসেটে মানুষ গান কম শুনলেও সিডির বিক্রি এখনো বেশ ভালো বলে জানালেন তিনি তার মতে, "নতুন শিল্পীদের গান মানুষ অত শুনছে না সেটা দুই বাংলাতেই তবে আগেকার যেসব গান আছে, সেগুলো এখনো মানুষ ব্যাপকভাবে শুনছে

রাঘব চট্টোপাধ্যায় শুভমিতার সাথে রেকর্ডিংয়ের ছবি দেখিয়ে বললেন,"ওনাদের সাথে সিডির কাজ চলছে এখনো বের হয়নি, সামনে আসবে

নামের মতোই ইউনিভার্সাল মিউজিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, ধ্রুপদী রাগসঙ্গীত ও রাগাশ্রয়ী বাংলস গান, অতুলপ্রসাদী, ভক্তিগীতি, সুফিগান সংকলন, আধুনিক গান, ফিল্মি গান, বিভিন্ন ওস্তাদদের বাজানো ইন্সট্রুমেন্টাল, পাশ্চাত্যের রক, জ্যাজ অ্যান্ড ব্লুজ, কোক স্টুডিওর ফিউশন ভলিউমসহ বহুরকম গানের সংগ্রহ  

তার দোকানের কালেকশনে আছে প্রায় একশ বছর আগের গ্রামোফোন রেকর্ডও জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, বড়ে গুলাম আলীরওশন আরাদের সময়ের রেকর্ডও আছে এখানে

সৈয়দ দানিক দেখালেন দুটো ডিস্ক - উমা বসু (হাসি) সাবিত্রী ঘোষের প্রথমটি ১৯৪০ দ্বিতীয়টি ১৯৩৬ সালের রেকর্ড, সুরসাগর হিমাংশু দত্তের সুর 

তিনি বলেন, "এমন আরো অনেক পুরনো রেকর্ড আছে এখানে কে এল সায়গলের সব বাংলা গান নিয়ে বেরোনো একটি সিডি দেখালেন, যেখানে আছে 'যখন রবো না আমি' কিংবা 'নাইবা ঘুমালে প্রিয়' এর মতো গান 

বললেন, "ওঁর (সায়গল) গানের এখনো খুব চাহিদা অনেকে গেয়েছেন, মানুষ এখনো খুব শোনে"

বড়ে গুলাম আলী ও জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর রেকর্ড। ছবি: লেখক

তবে জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী বা ডিভি পালুসকারের রেকর্ড যেমন আছে, তেমনি আছে কিশোর কুমার - আর.ডি বর্মণদের গানও। সৈয়দ দানিক বললেন, "রফি সাহেবের গানের একেকটা সিডির দাম একসময় তিন হাজার টাকা ছিলো, মানুষ তাও কিনে শুনেছে। অমিতাভের সিনেমার গানগুলোর সিডি এখনো খুব ভালো বিক্রি হয়। মানুষ যা শোনে তা রাখবো না কেনো? কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকরের গান এখনো খুবই চাহিদা রাখে।"

তার মতে, গানের বিভিন্ন ধারার ভেতর বিভাজন থাকা উচিত নয়। তিনি বললেন, "কেউ যদি পিতাকে অস্বীকার করে, তবুও সে পিতাই থাকে। উত্তম কুমার, দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন - এরা একেকজন বড় তারকা। এতো মানুষ এতো বছর ধরে তাদের সিনেমা দেখছে, গান শুনছে - এতে প্রমাণ হয় তারা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। কাজেই জনপ্রিয় হলেই কারো কাজ সস্তা এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আর যারা জনপ্রিয়তার কারণে তাদের অবমূল্যায়ন করে, এরা এক্ষেত্রে অকৃজ্ঞতার পরিচয় দেয়।"

মূলত এইচএমভি, আরপিজি বা সারেগামার মতো ব্রান্ডগুলোর গানের আমদানিকারক হওয়ায় এখানে ব্যান্ডের ক্যাসেট কম। তবে তাও একসময় তারা রাখতেন। সৈয়দ দানিক বললেন, “আইয়ুব বাচ্চু, জেমস ওরা তো ভালো আর্টিস্ট। একসময় ওদের গান খুবই চলতো। আমাদের এখানে তো আসিফের সিডিও আছে।''

তবে বর্তমানে ইউটিউব বা বিকল্প বিভিন্ন মাধ্যমে ভালো গান হলেও তিনি মনে করেন সেসব গান গণপর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে কম। ইউটিউব ওপেন প্লাটফর্ম হওয়ায় এখানে যে যেমনভাবে পারছে গাইছে, আর এতে সার্বিকভাবে সঙ্গীতের মানের অবনমন হচ্ছে বলে তার মত।

হেমন্ত, কিশোর, সুচিত্রা, সায়গল, সুফিয়ানা, হিন্দি সিনেমা,কোক স্টুডিওর গান, নানারকম বই - কী নেই এখানে!

তিনি বললেন, "সঙ্গীত তো সাধনার বিষয় জানতে হবে, পড়তে হবে, শুনতে হবে এখন যদি এমন হয় গান জানে না, কিন্তু টাকা আছে বা নিজের চ্যানেল আছে তাই গান বের করে ফেলবে, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে গান করবে কিংবা ভাইরাল হওয়ার জন্য হাস্যকরভাবে গান করবে- তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না"  

তার শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হবার ক্ষেত্রে অণুপ্রেরণা পেয়েছেন এস এম সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরী ও ড. সফিউদ্দিন আহমদ এর কাছ থেকে তিনি বললেন, ''সফিউদ্দিন স্যারের কাছ থেকেই মূলত সঙ্গীতের আগ্রহ পাওয়া তিনি আর্ট কলেজের শিক্ষক ছিলেন সুলতান স্যার, কাইয়ুম স্যারদের কাছেও আমি ঋণী আমাদের সৈয়দ পরিবারে গান-বাজনার চল ছিল না সফিউদ্দিন স্যারের অনুপ্রেরণাতেই এদিকে আসা''

গ্রামোফোনটি মনে করিয়ে দেয় সেসব দিনের কথা, ছবি: লেখক

সৈয়দ দানিক জানালেন ইউনিভার্সাল মিউজিকের সংগ্রহে আছে ১০ থেকে ১৫ হাজার সিডি এর ভেতর প্রচুর সিডি আছে রক, জ্যাজ অ্যান্ড ব্লুজ গানেরও অ্যারেথ্রা ফ্রাঙ্কলিন, এরিক ক্ল্যাপটনএলভিস প্রিসলি, পেরি কোমো, দ্য ব্রাদার্স ফোর, জনি ক্যাশসহ বহু শিল্পীর নাম এখানে উল্লেখ্য আছে বিখ্যাত বিভিন্ন বিশ্ব চলচ্চিত্রের অরিজিনাল মোশন সাউন্ডট্র্যাক 

তবে শুধু গানের সিডিতেই আর সীমাবদ্ধ নেই তারা সঙ্গীতবিষয়ক তো বটেই, পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন বইও রাখছেন তারা 

সৈয়দ দানিক জানালেন, "এখানে বিশ্বভারতীর অরিজিনাল প্রিন্টে ওদের সব বই পাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান গীতাঞ্জলি তো আছেই, তার চারখন্ডে প্রকাশিত বিশাল কলেবরের রচনাসমগ্রের ইংরেজি অনুবাদ আছে সবগুলো মিলে পুরো সেট ৪০,০০০ টাকা দাম

দোকানে চোখে পড় শম্ভু মিত্রের রচনাসমগ্র, তরুণ মজুমদারের 'বাতিল চিত্রনাট্য'- মতো বইগুলোও তিনি জানালেন, "আমি সঙ্গীতের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটাবার চেষ্টা করেছি গান শোনা যেমন দরকার, আবার শিল্পসম্বন্ধীয় এসব বইও পড়া দরকারএখানে উত্তম কুমার, দিলীপ কুমার, গুরু দত্ত, অমিতাভ বচ্চন, শ্রীদেবীসহ অনেককে নিয়ে লেখা বই আছে এসব তরুণদের পড়া দরকার"

সিডির পাশাপাশি এখানে আছে চমৎকার অনেক বইও, ছবি: লেখক 

গানের ডালি থেকে ইউনিভার্সাল মিউজিক - এই চারদশকে সাক্ষী হয়েছেন অসাধারণ সব অভিজ্ঞতার সে বিষয়েও কিছু বললেন- "আমাদের দোকানে, মানে আগের দোকানটায় (গানের ডালি) সলিল দা (সলিল চৌধুরী), মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী মজুমদার, পঙ্কজ উদাস বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন সুবীর দা (সুবীর নন্দী) আসতেন আড্ডা দিতে পাশে আমাদের আরেকটা অংশ আছে, রেকর্ডিংয়ের ১৯৮২-২০০০ এর সময়টায় সুবীর নন্দী, শুভ্র দেব, শাকিলা জাফর, শবনম মুস্তারী - এমন অনেকে রেকর্ড করতেন এখানে"

তিনি বললেন, "এখন নতুন শিল্পীদের গান হয়তো লোকে শোনে না, নতুন সিডি তেমন নেই কিন্তু আগেকার গান এখনো চলে আগের চেয়ে খরচ বেড়েছে, আগে ইলেকট্রিসিটি বিল তিনশ টাকা হলে এখন হয়তো তিন হাজার টাকা হয় কিন্তু পুরনো সিডিগুলোর ক্ষেত্রেও তাই যেমন এই রেকর্ডটা (ইংরেজি একটি রেকর্ড- স্যান্ডি উইলসনের) আশির দশকে হয়তো ৩০০ কপি যেতো, এখন ৩০০০ কপি যায় পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডগুলোও তাই গান যে মাধ্যমেই শোনেন, একই গান৷ তবে ইউটিউবে সব পাওয়া গেলেও সেসব রেকর্ড সিডিতে শোনার ভালো লাগা অন্যরকম তাই অনেকে এখনো সিডি কেনেন"

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চালু করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, সামনে চেয়ারে বসা সৈয়দ দানিক। ছবি: লেখক

দোকানের যেখানটায় তিনি বসেন, তার পেছনে বড় ব্যানারে লেখা 'বঙ্গবন্ধু কর্ণারএই অংশে আছে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা বই  তাকে নিয়ে লেখা অন্যান্যদের বই সৈয়দ দানিক বললেন, "বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ এটি শুরু করি এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ছাড়াও ওনাকে নিয়ে লেখা অন্যান্য বই, গবেষণাগ্রন্থ, অনুবাদ ইত্যাদি আছে এখানকার বইগুলো বিভিন্ন সাংবাদিকও নেন।”

কথাপ্রসঙ্গে বললেন, "নব্বই দশকে বড় বড় বিভিন্ন পত্রিকার যারা কালচার বিষয়ক নিউজ করতেন, প্রতিদিন সকালে দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত এখানে তাদের ভিড় লেগে থাকতো নতুন কী ক্যাসেট/ সিডি আসলো, কোনটা কেমন চলছে সেসব নিয়েই হতো জমজমাট আলোচনা

সময়ের পরিক্রমায় সঙ্গীত ইন্ড্রাস্ট্রিতে ব্যবসার জায়গায় অনেক পরিবর্তন এসেছে তবে সৈয়দ দানিক এখনো আস্থা রেখেছেন সিডিতেই আঁকড়ে ধরে আছেন বড় ভাইয়ের করে যাওয়া 'গানের ডালি' নাম পরিবর্তনে  ইউনিভার্সাল মিউজিক হয়ে সেই সঙ্গীত সমুদ্র অক্ষুণ্ণ আছে আজও, যা তিনি ধরে রাখতে চান আমৃত্যু

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। 

[email protected] 

Share if you like

Filter By Topic