Loading...
The Financial Express

ইউটিউব রান্নায় বিখ্যাত সেই শিমুলিয়া গ্রাম

| Updated: September 16, 2022 20:19:24


(উপরের সারিতে) অ্যারাউন্ড মি বিডির রাঁধুনীরা ও ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন, (নিচের সারিতে) মূল উদ্যোক্তা লিটন আলী খান ও ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপা কুকিং চ্যানেলের চার দাদু -  ছবি: অ্যারাউন্ড মি বিডি/ রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ড (উপরের সারিতে) অ্যারাউন্ড মি বিডির রাঁধুনীরা ও ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন, (নিচের সারিতে) মূল উদ্যোক্তা লিটন আলী খান ও ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপা কুকিং চ্যানেলের চার দাদু - ছবি: অ্যারাউন্ড মি বিডি/ রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ড

ইউটিউবের কল্যাণে এখন সবার কাছে পরিচিত নাম অ্যারাউন্ড মি বিডি ও ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপা'স কুকিং। এই চ্যানেল দুটোতে দেখা যায় গ্রামের মানুষদেরই বিভিন্ন রান্না-বান্নার কাজ করতে।

অ্যারাউন্ড মি বিডিতে দেখা যায় ১৫ জন নারীকে, আর ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপাতে ৩ জন বয়স্ক মানুষ বা দাদুকে। তারা একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে রান্নার কাজ করেন। ক্যামেরার সামনে শুভ্র হাসিতে বলেন, 'খুব টেস হইছে খাবার'। আলাদাভাবে কোনো ধারাভাষ্য নেই৷ তাদের বাজার নিয়ে আসা, কাটা-বাছা, মসলা কষানো, উনুনে রান্না চাপানো, তারপর গ্রামের মানুষদের দেয়া, নিজেরাও একসাথে খাওয়া-এসবকিছুই সাবলীলভাবে তুলে ধরা হয় এখানে, কৃত্রিমতা নেই। দর্শকদেরও মনে হবে তাদের সামনেই তাদের গ্রামে রান্না হচ্ছে। গ্রামে যাদের শিকড় তারা হয়ত মনে করতে পারবেন গ্রামের মজলিশ বা জেয়াফত এর খাবারের কথা।

ইউটিউবের কল্যাণে জনপ্রিয় হওয়া এই চ্যানেল দুটোর মানুষেরা কুষ্টিয়া জেলার। কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানার শিমুলিয়া গ্রামে হয়ে থাকে এই আয়োজন। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়াতেও ভূমিকা রেখেছে এই চ্যানেল দুটো।  

অ্যারাউন্ড মি বিডির শুরু ২০১৬ সালে। আর ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপা ২০২০ - এ। এই উদ্যোগগুলো নিয়েছেন লিটন আলী খান। তিনি পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস-এ। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রথম অ্যারাউন্ড মি বিডি চ্যানেলটি শুরু করেন ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই। তখন অবশ্য এমন রান্নার ভিডিও ছিল না। তিনি গ্রামের আশপাশের দোকান, প্রাকৃতিক দৃশ্য, হেঁটে যাওয়া মানুষ, মাঠে কাজ করতে থাকা কৃষক - এদের দেখাতেন ভিডিওতে। মূলত গ্রামকে পরিচিত করে তোলাই ছিল তার উদ্দেশ্য।  

পরবর্তীতে তিনি ঠিক করেন গ্রামে চাষাবাদ বা এ ধরনের কাজ করবেন। তবে ঢাকায় থাকায় ও পেশাগত ব্যস্ততা  থাকায় তার পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে কুষ্টিয়ায় বা শিমুলিয়া গ্রামে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি তার মামা মো.দেলোয়ার হোসেনকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেন।

দেলোয়ার হোসেন স্থানীয় মোল্লাপাড়া প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

তিনি জানান, “আমার ভাগ্নে ঢাকায় থাকে, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ২০১৬ সালের দিকের কথা। ওর খুব আগ্রহ ছিল গ্রাম নিয়ে, এখানকার চাষাবাদ বা মানুষদের নিয়ে। সে আমাকে এই ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দেয়”।

তারপর থেকে শুরু। লিটন আলী খান এখানে মূল ডোনার। ব্যবস্থাপনার কাজ করেন দেলোয়ার হোসেন। তারা ঠিক করেন গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে বাইরের মানুষকে পরিচিত করাবেন। তারপর এই চ্যানেলে বিভিন্ন রান্নার কাজ শুরু হয়।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, "আমাদের দুটা চ্যানেলের ভিতর অ্যারাউন্ড মি যেটা, এখানে রান্নার কাজ করেন ১৫ জন মহিলা। এর বাইরে আরো লোকজন আছে। সবমিলিয়ে ৫০ জনের মত মানুষ এটার সাথে যুক্ত। এর ভিতর কেউ বাজার করে, কেউ কাটা-বাছা করে, আর রান্না ওই মহিলারা করে। তাদের প্রত্যেকে মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে। দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা হিসাবে তারা মাসিক বেতন পেয়ে থাকে কাজের জন্য। এই চ্যানেলে যে খাবারগুলো রান্না করা হয় তা সাধারণভাবে গ্রামের সব মানুষের জন্য। বেশিরভাগ সময় মাছ বা মুরগি রান্না করা হয়। বিভিন্ন ধরনের মাছ রান্না করলে সেটা সবাই খেতে পারে।”

দেলোয়ার হোসেন আরো জানালেন মাঝে মাঝে গরু দিয়ে তেহারী/ বিরানী করেও গ্রামে দেয়া হয়। আর ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপা নিয়ে তিনি বললেন, “এই চ্যানেলটা আরো পরের। ২০২০ এর ৪ জুলাই শুরু। এটায় মূল লোক তিনজন। তারা বেশ বয়সী, মানে দাদু বলে পরিচিত। এ বয়সে অনেকে অন্য কাজ করতে পারেন না। সেইসব ভেবে আরকি তাদের এখানে নেয়া হইছে। তারা এখানে রান্না করেন একসাথে। সবাই দৈনিক ৪০০ টাকা হিসেবে বেতন পান। এখানে যেসব খাবার রান্না হয়, সেটা ওই চ্যানেলটার মতই। তবে  এটা গ্রামের একেবারে দরিদ্র মানুষ, প্রতিবন্ধী, যারা চলাচলে অক্ষম বা অন্য কোনভাবে সুবিধাবঞ্চিত- এসব মানুষদের কথা চিন্তা করে করা। মূলত মানুষকে সহায়তার জন্যই আলাদাভাবে এটা করা। এখানে রান্না হওয়া খাবার অন্যান্য গ্রাম বা উপজেলাতেও যায়। যেমন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মানুষদের কাছেও রান্না করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

অ্যারাউন্ড মি বিডির চ্যানেলে যে মহিলারা রান্না করছেন, তারা আগে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির কাজ, কৃষিকাজ করতেন। এখানে যুক্ত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। তারা মাসে ৮০০০ বা তার বেশি টাকা পাচ্ছেন। এদের কেউ কেউ আবার এক পরিবারের। যেমন - শাশুড়ি-বউ কিংবা ননদ-ভাবি।

ভিলেজ গ্র‍্যান্ডপায় মূল তিনজন দাদু ছাড়াও বাজার ও কাটাবাছায় আছেন আরো নয়জন। দুই চ্যানেল মিলে আরো চারজন ক্যামেরাপার্সন আছেন এখানে। দাদু তিনজনের নাম লোকমান আলী, লিয়াকত আলী ও আতিয়ার আলী। এদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা যায় আরেক দাদুকে, যার নাম নেয়াব আলী শেখ।

ইতোমধ্যে চ্যানেলটির পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। প্রখ্যাত ফুড রিভিউয়ার সানি সাইড নিজে এসেছিলেন এখানে। ভারত, পাকিস্তান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আছে এই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার। মোট দর্শকের ৩০ শতাংশের বেশি দর্শক দেশের বাইরের, বিশেষত ভারতের।

চ্যানেল দুটোর কল্যাণে কুষ্টিয়ার শিমুলিয়া গ্রাম বর্তমানে পরিচিতি পেয়ে গেছে 'ইউটিউব গ্রাম' হিসেবে। স্থানীয় মানুষের আর্থিক উন্নতি যেমন ঘটেছে, তেমনি গ্রামটিও পেয়েছে বৈশ্বিক পরিচিতি।  আবার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কেউ কেউ খাবারের পাশাপাশি ঘর বা অন্যান্য সুবিধাও পেয়েছেন উদ্যোক্তা লিটন আলী খানের তরফ থেকে।

দেলোয়ার হোসেনের কথায়, "লিটনের ইচ্ছা ছিল গ্রামের মানুষকে সাথে নিয়ে কিছু করবে, সেটা আমরা পেরেছি। আমার বাড়ির উঠানেই নিয়মিত রান্না হয়। যেদিন রান্না হয় ২০০-৩০০ মানুষ খাওয়ানো যায়। গ্রামের মানুষেকে আমরা ভালো খাবার দিতে পারছি, এটা অবশ্যই আনন্দের বিষয়।"

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic